রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তুত ভাসানচর

রফিক উদ্দিন বাবুল, উখিয়া :

রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ‘আশ্রয়ণ-৩’ নামে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ভাসানচর বসবাসের উপযোগী করার জন্য, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন সৃজন ও দ্বীপটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ প্রকল্প সরাসরি তদারকি করার নিমিত্তে ভাসানচর দৃশ্যমান প্রকল্পে উন্নীত হয়। পরবর্তীতে এটাকে ঘিরে আবাসন নির্মাণের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে সম্ভাব্যতা নিরীক্ষা করে প্রণয়ন করা হয় ডিপিপি। প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। বাঁধ ও জেটি নির্মাণের জন্য পরে প্রকল্প ব্যয়ভার বাড়িয়ে তিন হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয় বলে জানা গেছে।
চারদিকে সবুজের সমারোহ। গাছগাছালির ছায়ায় পাখির কলতান। পুরো চর ঘিরে উঁচু বাঁধের সুরক্ষা ব্যবস্থা। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক সব স্থাপনা।
অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভূমি থেকে চার ফুট উঁচুতে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে বসবাসকারীরা যাতে দুর্যোগকালীন আশ্রয় নিতে পারেন, সে জন্য রাখা হয়েছে একটি শেল্টার স্টেশন। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ২৩টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টারে পুরুষ ও নারীদের আলাদা গোসলখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। ক্লাস্টার হাউসে রয়েছে রান্না করার সুব্যবস্থাও। ভাসানচরের শেল্টার স্টেশন স্টিল ও কংক্রিটের কম্পোজিট স্ট্রাকচারে তৈরি। বাস্তুচ্যুত হিসেবে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ভাসানচরে রয়েছে। এ প্রকল্পে রয়েছে চারটি ওয়্যার হাউস। এক লাখ রোহিঙ্গার তিন মাসের ত্রাণসামগ্রী সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে সেখানে। প্রতিটি ক্লাস্টারের সঙ্গে রয়েছে একটি পুকুর। অগ্নিনির্বাপণের কাজেও পুকুরের পানি ব্যবহার করা যাবে। এমনটাই জানালেন সম্প্রতি ভাসানচর থেকে ঘুরে আসা রোহিঙ্গা প্রতিনিধি নেতৃবৃন্দ।
ভাসানচর ঘুরে আসা জিয়া মাঝি, আমিন মাঝি ও জকরিয়া মাঝি জানান, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সাময়িকভাবে স্থানাস্তরের জন্য এই ভাসানচরে এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন। গুচ্ছগ্রামের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এসব ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি গৃহ। প্রতি গৃহে রয়েছে ১৬টি রুম। একেক রুমে চারজন থাকার ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য শতভাগ প্রস্তুত ভাসানচর। আধুনিক বর্জ্য ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ও সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছেন। এসব রোহিঙ্গার মধ্য থেকে একটি অংশ যদি ভাসানচরে চলে যায় তাহলে এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা একটু স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলতে পারবে। পাশাপাশি ভাসানচরে যারা পুনর্বাসন হবে তারাও আরাম আয়েশে দিন যাপন করতে পারবে।
সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা। দ্বীপটিতে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হবে। তারা মিয়ানমারে তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের ভূমিহীন ও দুস্থ নাগরিকদের ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হবে। চরটি সমুদ্রের মধ্যে থাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চারদিকে এখন ৯ ফুট উচ্চতার বাঁধ রয়েছে। এটা ১৯ ফুট পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে হাসপাতাল, বাজার ও খেলার মাঠ। রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের জন্য অভ্যন্তরীণ রাস্তা, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য ভাসানচরে গ্রামীণ ও রবি মোবাইল বিটিএস স্থাপন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রতিটি ব্যারাক ঘরে রয়েছে পৃথক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা। প্রতিটি শেল্টারে পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আলাদা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে- যার মাধ্যমে শেল্টার স্টেশন আলোকিত করার পাশাপাশি সৌরপাম্প ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করা সম্ভব। বর্তমানে ভাসানচরের ক্লাস্টারে মোট ৩০৬ জন রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৯৭, নারী ১৭৬ ও শিশু ৩৩ জন। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে আটকের পর তাদের ভাসানচরে নির্মিত ক্লাস্টারে নিয়ে রাখা হয়।
ভাসানচর বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এর আয়তন ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। দ্বীপটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে সাড়ে ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। ভাসানচরে বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী ভূমি রয়েছে ছয় হাজার ৪২৭ একর। এর মধ্যে এক হাজার ৭০২ একর জমির ভেতরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার কাজে ৪৩২ একর ও ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য ৯১৮ একর ফাঁকা রাখা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি ভবিষ্যতে নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইস তৈরির জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড শরণার্থী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ মাওলানা জালাল জানান, ২০১৭ সালের আগে ও পরে যে সমস্ত রোহিঙ্গা এসেছে তারা ভাসানচরে যেতে রাজি নয়। তবে মাঝামাঝি সময়ে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে জীবনমান ভাসমান অবস্থায় রয়েছে তাদের একটি অংশ ভাসানচরে যেতে রাজি আছে। এরপরেও বেশ কিছু রোহিঙ্গা যারা ক্যাম্পে বেহাল অবস্থায় রয়েছে তারা ভাসানচরে সুবিধার বর্ণনা শুনে যেতে রাজি হয়েছেন। তবে ক্যাম্পে থাকাকালীন অবস্থায় বেশ কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা যারা চাঁদাবাজি অপহরণ, খুন, গুম ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত তাদের কারণে ভাসানচরে রোহিঙ্গারা যেতে পারছে না।
কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ মো. খলিলুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভূমিধসের উচ্চ ঝুঁকি থাকায় রোহিঙ্গাদের ঘরগুলো ঝুঁকির মধ্যে আছে। আবার ঘূর্ণিঝড়কালীন ঝুঁকি আরও বাড়বে। তবে ভাসানচরে ১২০টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এলেও রোহিঙ্গারা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। এ ছাড়া কক্সবাজারে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে পর্যটনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ভাসানচরে তাদের একাংশের স্থানান্তর হলে সেখানকার পর্যটনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আবার রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে থাকলে মানব ও মাদক পাচারে তাদের সংশ্নিষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। ভাসানচরে স্থানান্তর হলে এটা নিয়ে আপাতত চিন্তার কোনো কারণ থাকবে না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা রান্নার কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বনের ওপর নির্ভরশীল। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।