মাতৃদুনিয়ার প্রতি বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা

রায়হান আহমেদ তপাদার »

পরিবেশ সুরক্ষা ও মাতৃদুনিয়ার দুর্দশার প্রশ্নটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বিচারহীন পরিবেশ-মুমূর্ষু দুনিয়ায় পরিবেশ সুরক্ষা প্রশ্নকে বারবার অরাজনৈতিক করে দেখা হয়। বাহাদুরি আর ক্ষমতার গণিতকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। যেন পরিবেশ সুরক্ষা মানে হলো কিছু গাছের চারা লাগানো’ কিংবা প্রাকৃতিক বনভূমিকে ‘সংরক্ষিত বন’ বানানো বা জলাভূমিকে দখল করে ‘অভয়াশ্রম’ নাম দেয়া। বড়জোর কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে সমন্বিত বালাইনাশক পরিবর্তিত জিএম বিটি বেগুনের’ অনুমোদন। একটি অন্যায় ঢাকতে গিয়ে আরেকটি জুলুম চাপিয়ে দেয়া। একটি করপোরেট বাহাদুরির সঙ্গে আরো প্রশ্নহীন অন্যায়ের বৈধতা। পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নকে স্থানীয় প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ঐতিহাসিকতা থেকে দেখতে হবে।
প্রাণবৈচিত্র্যের সঙ্গে চারপাশের নানা জীবনের জটিল বহুমাত্রিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েই পরিবেশ সুরক্ষার যাত্রা শুরু করতে হবে। মাটি বাঁচাতে গিয়ে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করে মনসান্টোর হাইব্রিড ভুট্টা বীজের অনুমোদন দেয়ার মাধ্যমে এটি হতে পারে না। কারণ এ হাইব্রিড ভুট্টাবীজ স্থানীয় বীজ সংস্কৃতিকে আঘাত করে। এটি পরাগায়ণে অভ্যস্ত পতঙ্গ পাখির জন্য হুমকি তৈরি করে। মাটির স্বাস্থ্য ও গঠন ওলটপালট করে দেয়। গাছ লাগালেই পরিবেশ রক্ষা হয় না। গাছ লাগানোর নামে সারা দেশে একাশিয়া আর ইউক্যালিপটাসের মতো আগ্রাসী গাছের অনুমোদন কোনোভাবেই পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে না। কারণ এসব আগ্রাসী গাছ মাটির তলার জল শুষে নেয় মাত্রাতিরিক্ত হারে, পরাগরেণু এলার্জি তৈরি করে আর পশুপাখির জন্য বিপজ্জনক খাদ্য-বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।একটা সময় রাজা-বাদশাহের আমলে বাঘ, হরিণ, বুনোমহিষ, গয়াল, অজগর, গ-ার খুন করাকে ‘অভিজাতপনা’ হিসেবে দেখা হতো। সেই কাল চলে গেছে। বন্যপ্রাণি হত্যাকে রাষ্ট্র এখন ‘অবৈধ’ ও ‘বেআইনি’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু তার মানে কি বন্যপ্রাণি হত্যা বন্ধ হয়েছে? বরং বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য আরো মোটাতাজা হয়েছে। চাইলে বাঘ কি বনরুই নিমেষেই হাজির হবে। শুধু পয়সা ছড়ালেই হয়। সবুজ বিপ্লবের নামে মাটি ও শস্যদানা সব আজ বিষাক্ত। কিন্তু এই বিষ কে খাচ্ছে? আর কে খেতে চাইছে না? বলা হয় সচেতন মানুষ সার-বিষে ভরা এমনতর ‘অনিরাপদ খাদ্য’ খেতে চায় না। তারা গ্রামের টাটকা ফলফলাদি, গৃহস্থ বাড়ির সতেজ দানা আর নদীর খলবলে মাছ খেতে চায়। এই ‘সচেতন’ মানুষ কারা? গ্রামের গরিব কৃষিমজুর না শহরের ধনী চাকুরে বা ব্যবসায়ী? সবাই সচেতন হলেও গ্রামের গরিব কৃষিমজুর, যারা আজও কৃষি-জুমের দা-হাল ধরে রেখেছে তাদের পক্ষে কি সার-বিষহীন নিরাপদ খাবার খাওয়া সম্ভব?আজ দুনিয়া আরো এক মুক্তির আন্দোলনে শামিল। পরিবেশবিনাশী বাহাদুরির বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম।
এই মাতৃদুনিয়ার টিকে থাকার শর্ত ও কারিগরি সুরক্ষার লড়াই। কেবল ফুল, পাখি, মাছ, জল, জঙ্গল, মাটি, মানুষ নয়। আজ আর একটি-দুটি দেশ কেবল নয়। পৃথিবী নামের এই গ্রহ আজ জীবন-মরণের এক প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়েছে। কারণ ২০০ বছর ধরে পৃথিবীকে নিয়ে ধনী আর উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রগুলো এক নির্দয় খেলা খেলে চলেছে। খেলাটির বাহারি নাম ‘শিল্প বিপ্লব’ এবং ‘উন্নয়ন’। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে দুনিয়ার নদী ¯্রােতগুলো বাঁধ দিয়ে খুন করা হয়েছে। অরণ্যের হাড়-পাঁজর খুবলে টেনে তোলা হয়েছে বুকের দম আর ধমনীর রক্ত। বাজারের অভিধানে যার নাম কয়লা, তেল আর গ্যাস। দুনিয়ার সব কৃষিজমির মাটি আজ বিষাক্ত আর পিপাসার্ত। প্রতিদিন এ মাটি আজ সার ও বিষ খেতে চায়, প্রতিদিন বাড়ছে পানির জ্বালা। কৃষিকে ঘিরে এ হত্যাকা-ের পুস্তকি নাম ‘সবুজ বিপ্লব’। এ কেবল বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় দুনিয়া নয়, এ ঘটনা বিশ্বব্যাপী ঘটে চলেছে। এক নির্দয় প্রশ্নহীন রক্তপাত। কিন্তু এই কি ঘটে চলবে? এভাবেই কি মাতৃদুনিয়ার করুণ মরদেহ নিয়ে দাঁড়াবে মানুষ। দুনিয়ার ৭০০ কোটি মানুষের কি কোনো দায় নেই? তবে ৭০০ কোটির দায় ও দায়িত্ব কি সমান? নিশ্চয়ই নয়। প্রতি বছরের মতো এবারের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার’। করোনা মহামারিকাল প্রমাণ করেছে প্রাণ-প্রকৃতি আর বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা ছাড়া এই গ্রহ বাঁচবে না। কিন্তু এ গ্রহের শরীর-মনে উন্নয়নের যে ক্ষত মানুষ তৈরি করেছে, সেই ক্ষত মানুষকেই সারাতে হবে। বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বৈশ্বিক সংহতি গড়ে তুলতে হবে।করপোরেট চেইন শপগুলো যেসব খাবারের নাম দিয়েছে ‘অর্গানিক ফুড’?
কারণ নিরাপদ খাবারের দাম বেশি। প্রশ্নটা কিন্তু অন্য জায়গায়। এসব সার-বিষের ব্যবসা কে করে আর এসব ব্যবহার করে কারা? মনসান্টো কোম্পানির রাউন্ডআপ সারা দুনিয়ার বহুল বিক্রীত আগাছানাশক। বাংলাদেশের চা-বাগানেই এর ব্যবহারের অনুমোদন আছে। সিনজেন্টা কোম্পানির রিফিট নামের একটি আগাছানাশক বাংলাদেশের সর্বত্র বিক্রি হয়। দেখা গেছে এসব রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জমির শাক-লতাগুল্ম ও ঔষধি গাছ-লতা সব মারা যায়। শামুক, কেঁচো, কুঁচে, ঘুঘরা পোকা, মাকড়সা, ফড়িং মরে যায়। এসব ব্যবহারের ফলে মানুষও আক্রান্ত হয় পেট ও শ্বাসনালির নানা জটিল রোগে। নিরাপদ খাদ্য আর নিরাপত্তা বলতে এই গরিব নিম্নবর্গের জন্য কিছুই নেই। সব নিরাপদ আর নিরাপত্তা বহুজাতিক কোম্পানির মালিকদের। তার মানে রাজা-বাদশাহর আমল শেষ হলেও বিদ্যমান শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও বৈষম্যমূলক মনস্তত্ত্ব গায়েব হয়ে যায়নি। বরং আরো ভিন্নরূপে জোরালো ও দশাসই হয়েছে। গোটা দুনিয়া আজ করপোরেটদের হাতে জিম্মি। মাতৃদুনিয়া কারো একতরফা পণ্য নয়। এটি কোনোভাবেই আমরা হতে দিতে পারি না। দুনিয়ার শরীর ও স্বাস্থ্যকে বহুজাতিক জিম্মায় ছেড়ে দিতে কোনোভাবেই আমাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারি না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি, আইন ও সনদ তৈরির ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই তা নিম্নবর্গের আকাক্সক্ষা ও মনোজগতকে স্পর্শ করে না।
তাই দেখা যায়, অধিকাংশ নীতিমালাই বছরের পর বছর কার্যহীন ও বিকল সময় পাড়ি দেয়। নীতিমালা গ্রহণের এই জনবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে জনগণের যাপিত জীবনের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করেই নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। কারণ একটি নীতিমালায় দেশের সামগ্রিক দর্শন, মূল্যবোধ, চিন্তা কাঠামো, রাজনৈতিক পরিসর ও রাষ্ট্রের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদি নীতিমালার মাধ্যমে রাষ্ট্রের দর্শনই জনগণের দর্শন হিসেবে চাপানো হয়, তবে আর রাষ্ট্রের জনগণতান্ত্রিক পরিচয় নেয়ার দরকার থাকে না। তাই একটি নীতিমালায় দেশের জনগণের সামগ্রিক চিন্তা ও দর্শনই কোনো জাতীয় নীতিমালার কেন্দ্রীয় মৌল ভিত্তি হওয়া প্রয়োজন। নিদারুণভাবে পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত বিরাজমান নীতিগুলো জনগণের সামগ্রিক স্বর ও ভঙ্গিকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই দেখা যায়, দুম করেই পরিবেশ প্রক্রিয়ার সামগ্রিক শৃঙ্খলাকে তছনছ করেই কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। বাঁধ, প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাহীন উত্তোলন, বিনোদন পার্ক, সামাজিক বনায়ন, বহুজাতিক রাসায়নিক কৃষি, অবকাঠামো, বৃহৎ সড়ক ও রেলপথ, নগরায়ণ, কল-কারখানা, শিল্পদূষণ এ রকমের নানান উন্নয়ন-মারদাঙ্গা আজ বাংলাদেশসহ মাতৃদুনিয়াকে গলা টিপে হত্যা করে চলেছে। মাতৃদুনিয়াকে সুস্থ রাখতে হলে দরকার বিশ্বব্যাপী গণজাগরণ। দরকার দেশে দেশে নিম্নবর্গের দর্শন ও পরিবেশ সংগ্রামের সঙ্গে ঐক্য ও সংহতি। সুন্দরবনের মৌয়াল ও বাওয়ালি থেকে শুরু করে সঙ্গে অ্যামাজন বনের আদিবাসীদের পরিবেশ সুরক্ষার বিজ্ঞানকে আগলে দাঁড়ানো জরুরি। কিলিমানজারো থেকে কৈলাস, কামচাটকা থেকে কেওক্রাডং, প্রেইরি থেকে যমুনার বিস্তীর্ণ কাশবন, গোবি মরুভূমি থেকে নীলনদ রাষ্ট্র নয়, সংহতি গড়ে উঠুক বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে বাস্তুসংস্থানের। এক পরিবেশ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরেক পরিবেশ প্রক্রিয়ার। এক প্রতিবেশ ভূগোলের জনজীবনের সঙ্গে আরেক প্রতিবেশ ভূগোলের।
পরিশেষে বলব,জাগতে হবে ধনী আর বিলাসীদের, যারা একই সঙ্গে শিক্ষিত, আধুনিক আর ‘উন্নত’ হিসেবেও পরিচিত। মাতৃদুনিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতার ব্যাপারে তাদের বাধ্য করতে হবে। এবং অন্যায় ভোগ-বিলাসিতার কারণে মাতৃদুনিয়ার শরীর ও মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার দায়ভার দুনিয়ার সব ধনী, বিলাসী উচ্চবর্গকে নিতেই হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ দূষণ রোধে বিশেষ করে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বায়ুদূষণ রোধ, প্রাকৃতিক পানির উৎস সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে দেশব্যাপী নাগরিকদের সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি এ খাতগুলোয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নাগরিক অংশগ্রহণ ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতে এখনই সময় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের।
বিশ্বব্যাপী নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করার কারণে বন ও বন্যপ্রাণি হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণে আজকের পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্যমতে, এখনই সময় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে পুনর্বিবেচনা করে সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয়ার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস রোধে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ প্রাণ ও প্রকৃতি তথা জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং তার বাস্তবায়নে নাগরিকদের সোচ্চার হতে হবে। একই সঙ্গে বন্যপ্রাণিসহ বনজ ও প্রাণিজ সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা, নাগরিক এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। সর্বোপরি পৃথিবীতে মানবজাতিকে টিকে থাকতে হলে প্রকৃতিপ্রদত্ত বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষা করেই বাঁচতে শিখতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট