মহাকাশ বিস্ময় : সক্রেটিস থেকে জেমস ওয়েভ

শঙ্কর প্রসাদ দে »

খৃষ্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে জন্ম নেয়া সক্রেটিসকে আধুনিক সভ্যতার জনক বলার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তি আর কার্যকারণ ছাড়া পৃথিবীর কোন ঘটনাকেই তিনি স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। শহরে হাঁটতে হাঁটতে যুবকদের উদ্দেশে বলতেন, দেবতাদের আক্রোশে জোয়ার ভাটা হয় না। এখানে নিশ্চয়ই চন্দ্র সূর্যের কোন যোগাযোগ আছে। ভেবে দেখোতো কেন হয়? এরকম অজ¯্র প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন।
এসব প্রশ্নগুলো ডায়ালগ আকারে পুস্তকাবদ্ধ করেন তাঁর যোগ্য শিষ্য প্লেটো। তিনিও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে অদৃষ্টবাদী কোন ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে রাজী ছিলেন না। তাঁর একাডেমিই সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম প্রতিষ্ঠিত বিশ^বিদ্যালয়। প্লেটোর ছাত্র এরিস্টোটল গুরুর মতবাদ অনুসরণ করলেন বটে কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের কিছু তত্ত্বের অবতারণা করলেন। যেমন ভারি বস্তু পানিতে ভেসে থাকার কারণ বস্তুটি সমতল। অবশ্য গ্যালিলিও এসে বললেন, বস্তু সমতল বলে নয়, বরং বস্তু পানি অপসারণ করে বলে ভেসে থাকে। খানিকটা ভুল বললেও এরিস্টোটলই বৈজ্ঞানিক চিন্তার অবতারণা করেন।
মহাকাশ বিজ্ঞানের জনক হিসেবে ১০০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া টলেমিকে গণ্য করা হয়। তিনিই প্রথম বললেন, পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরছে এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র সূর্য অনবরত ঘুরছে। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র সূর্য ঘুরার বক্তব্যটি ভুল হলেও পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য অনবরত ঘুরছে, এই বক্তব্যটি ছিল সঠিক। ১৪৭৩ খৃষ্টাব্দে জন্ম নেয়া পোলিশ বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস বললেন, পৃথিবী নয় বরং সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহ অবিরাম ঘুরছে পদার্থবিদ্যার চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়মে। কোপার্নিকাস সূর্যকেন্দ্রিক সৌরচক্রের আবিষ্কার দিয়ে মানবসভ্যতাকে টলেমির অর্ধভুল থেকে উদ্ধার কেেরছিলেন। এরপর থেকে সভ্যতাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এবার মহাকাশ বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটনালেন ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া গ্যালিলিও। ১৬০৮ সালে ওলন্দাজ চশমা কারিগর লিপেরশাইম এমন এক কাঁচ আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে বহু দূরের বস্তুকে বড় আকারে দেখা যায়। এটার উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিও আবিষ্কার করলেন টেলিস্কোপ। এই যন্ত্র দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো গ্রহ যেমন পৃথিবী, শুক্র, বুধ, শনি, বৃহস্পতি অবিরাম নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরছে। গ্যালিলিও এই মহাকাশ পর্যবেক্ষণ সৃষ্টি রহস্যের দ্বার উন্মোচন করল দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিক নীতিমালায়।
কেন ঘুরছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিউটন কর্তৃক আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া গেল হাতেনাতে। পৃথিবীর উপরিভাগ সমতল এবং গোলাকার হওয়া সত্ত্বেও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে আমরা ছিটকে পড়ে যাই না। গ্রহ তারা নক্ষত্রের নিজ নিজ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে একে অন্যের চেয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে ঘুরছে এবং একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। সক্রেটিস দেব দেবীর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে অস্বীকার করে প্রাকৃতিক নিয়মের যে দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করেছিলেন তা এবার পরিণতি পেল মার্কিন জোর্তিবিজ্ঞানী এডুইন হাবলের যুগান্তকারী আবিষ্কারে।
আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালে। তিনি বিখ্যাত হযে উঠলেন সেই বিখ্যাত আলোর বেঁকে যাওয়ার তত্ত্ব দিয়ে। আলো বেঁকে যায় স্থানকালের পদার্থবিজ্ঞানের মহাজাগতিক ঘূর্ণনের তাত্ত্বিক নিয়মে। আইনস্টাইন বলেছিলেন ব্রহ্মা- স্থির। আদি থেকে অনাদিকাল এটি ঘুরছে ঠিকই তবে এর অবস্থান মহাকালে স্থির এবং অবিনশ^র। এর শুরু ও শেষ বলতে কিছু নেই। এডুইন হাবলের জন্ম আইনস্টাইনের জন্মের ১০ বছর পর ১৮৮৯ সালে। হাবল মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ব্রহ্মা-ের সকল গ্রহ, তারা, গ্যালাক্সি একে অন্যের নিকট থেকে দুরে
সরে যাচ্ছে। একটি তারা পৃথিবী থেকে যতদূরে পৃথিবী থেকে ঐ তারার পিছনে সরে যাবার হারও তত বেশি এবং সমানুপাতিক। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার ‘হাবল ল’ ন্যামে খ্যাত। ব্রহ্মা-ের সব গ্রহ তারা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাওয়ার এই তত্ত্ব পরিষ্কার ধরা পড়ল টেলিস্কোপে। এবার উল্টো করে ব্যাখ্যা করে দেখা গেল, এখন ক্রমাগত একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরছে। তাহলে অতীতের দিকে একে অন্যের নিকট থেকে নিকটবর্তী ছিল। অবলোহিত রশ্মি ব্যাখ্যা করে দেখা গেল সুদুর অতীতে তারা, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, পরস্পর গাদাগাদি করে ছিল। অঙ্কে কষে দেখা গেল ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে সমস্ত বিশ^ব্রহ্মা- এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল।
বিজ্ঞানীরা এই বিন্দুটির নাম দিয়েছেন ‘সিঙ্গুলারিটি”। অসম্ভব উত্তপ্ত এই বিন্দুটি হঠাৎ করে কল্পনাতীত প্রচ- গতিতে ফেটে পড়ে। শুরু হল ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি প্রক্রিয়া। অসীম ভরের আধার এই বিন্দুুটি থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ভগ্নাংশ মহাশূন্যে ছুটছে তো ছুটছেই। বিজ্ঞানী হয়েল গিরকর ফেসিলহান হাবল এর আবিষ্কৃত এই বিস্ফোরণের নাম দিয়েছেন বিগব্যাং। সৃষ্টি হতে লাগল গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কাপি-, ধুমকেতু, গ্যালাক্সি, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি। আজো সৃষ্টি হচ্ছে গ্রহ, উপগ্রহ, তারা, গ্যালাক্সি। আবার অনেক গ্রহ, উপগ্রহ, তারা বিলীন হয়ে যাচ্ছে
‘কৃষ্ণগহ্বরে’। ২৪ এপ্রিল ১৯৯০ নাসা পৃথিবী থেকে ৫৯৬ কিলোমিটার ওপরে মহাকাশে স্থাপন করে একটি আধুনিক টেলিস্কোপ। হাবলের নামে এটির নামাকরণ হয় ‘হাবল টেলিস্কোপ’। এবার ব্রহ্মা-ের যে ছবি আসা শুরু হল, তাতে পরিষ্কার ধরা পড়ল, জোতির্বিদ হাবলের বক্তব্যই সঠিক। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব দিয়ে ব্রহ্মা-ের গতি প্রকৃতির প্রমাণ মিলল হাতে নাতে কিন্তু ব্রহ্মা- স্থির মর্মে আইনস্টাইনের ধারণা নাকচ হয়ে গেল। বিস্ময়কর বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও গ্যালিলিও এবং হাবলের বিগ ব্যাং তত্ত্বকে অঙ্ক কষে প্রমাণ দিলেন এবং দেখিয়ে দিলেন ব্রহ্মা- সৃষ্টির মোটামুটি বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন বছর। গত ১৩ জুন ২০২১ হাবল টেলিস্কোপ অকার্যকর হয়ে গেছে ৩১ বছর কাজ করার পর। এবার নতুন যন্ত্রপাতি, উন্নত প্রযুক্তি, বড় ও আরো উন্নত লেন্স সমৃদ্ধ টেলিস্কোপ মহাশূন্যে স্থাপনের জোর প্রস্তুতি চলছে। এটি স্থাপিত হবে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার ওপরে মহাশূন্যে। ধারণা করা হচ্ছে নাসার দ্বিতীয় পরিচালক প্রয়াত জেমস ওয়েভের (মৃত্যু ১৯৬৮) নামে অঙ্কিত জেমস ওয়েভ টেলিস্কোপটি ব্রহ্মা-ের আরো নিখুঁত তথ্য ও ছবি পাঠাবে। এটাও ধারণা করা হচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে পদার্থবিদ্যার সুনির্দিষ্ট নিয়মে হঠাৎ বিস্ফোরণে ব্রহ্মা-ের সৃষ্টি, স্থিতি, বিকাশ ও অনন্তযাত্রা। এ অনন্ত যাত্রার শেষ কোথায় মানুষ এখনো তা জানে না।

লেখক : আইনজীবী, হাইকোর্ট
ংঢ়ফবু২০১১@মসধরষ.পড়স