মকামে ইবরাহীম : একের ভেতর অনেক

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ তাআলাই সমস্ত হাম্দ ও সানার মৌলিক হকদার, যিনি বান্দার সৃজন পালন, জীবন-মৃত্যু ও তার জীবনোপকরণের নিয়ন্ত্রণকারী। তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করি, যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য সামগ্রিক পবিত্রতার শর্তজুড়ে দিয়েছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি কৃতজ্ঞ বান্দার জন্য নেয়ামত বাড়িয়ে দেন। তিনি আমাদেরকে মনের ভাব ব্যক্ত করার শক্তি দিয়েছেন।
আল্লাহ্ এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সকল সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর। জরা, ব্যাধি, ক্ষয়, লয়, মৃত্যু থেকে তিনি পবিত্র। আমাদের মুক্তির পথনির্দেশক, ¯্রষ্টার বাণী বাহক হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল যাঁর মাধ্যমে ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির সেতুবন্ধন রচিত।
বয়ঃপ্রাপ্ত প্রত্যেক মুমিন নরÑনারীর ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয। ঈমান’র পরই নামায’র স্থান। ইবাদতে বদনী অর্থাৎ দৈহিক ইবাদত হিসাবে নামাযের কোন বিকল্প নেই। প্রত্যেক নবীÑরাসূলই নামায আদায় করেছেন। কুফ্র ও ঈমান’র পার্থক্য নিরূপণ’র মানদ- নামায। নামায আদায়ের পূর্বে অন্যতম শর্ত হল ক্বিবলামুখী হওয়া। মুসলমানদের প্রাচীনতম ক্বিবলা ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস। হিজরতÑপরবর্তী দ্বিতীয় বর্ষে আল্লাহ্র প্রিয়তম হাবীব আমাদের আÑক্বাও মাওলা, হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ঐকান্তিক আগ্রহের প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তাআলা ক্বিবলা পরিবর্তন করেন। আর সেই থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ক্বিবলা নির্ধারিত হয় খানায়ে কা’বা বাইতুল্লাহ্ শরীফ। এ প্রসঙ্গে নিজের স্থির সিদ্ধান্ত জানিয়ে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ তাআলা আয়াত নাযিল করেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনার চেহারা বারংবার আসমানের দিকে ফেরানোর বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য করছি। সুতরাং, আপনাকে নিশ্চয় সেই ক্বিবলার দিকেই ফিরায়ে দেবো, যেটার প্রতি আপনি সন্তুষ্ট। অতএব, আপনি আপনার চেহারা মসজিদে হারামের দিকে ফিরিয়ে নিন, আর ( হে মুসলমানগণ) তোমরা যেখানেই থাকো, নিজেদের চেহারা সেদিকেই ফিরাও’। (সুরা বাকারাÑ১৪৪)
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা যায় যে, খানায়ে কা’বা বিশ্ব মুসলিমের ক্বিবলা হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে আল্লাহ্র প্রিয় নবীর পছন্দ। তিনি একান্তভাবে প্রত্যাশা করেছিলেন কা’বা শরীফই হোক আমাদের ক্বিবলা। আর আল্লাহ্ তাÑই মঞ্জুর করেন। কারণ, তাঁর কাছে তাবৎ সৃষ্টি গৌণ, এসব কিছুই তিনি হাবীব (দ.)’র জন্যই সৃষ্টি করেন। পূর্বÑপশ্চিম বা মসজিদে আকসাÑ কোনটাই তাঁর হাবীবের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই, তাঁর পছন্দে ক্বিবলা পরিবর্তন হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়।
সুরা আÑ লো ইমরান’র ৯৬ ও ৯৭তম আয়াতে রাসূলুল্লাহ্ (দ.) কাক্সিক্ষত ক্বিবলা আল্লাহ্র ঘর বাইতুল্লাহ্ শরীফ’র একাধিক বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম গৃহ, যা মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত হয়েছে, তা হলো সেটাই যা মক্কায় অবস্থিত, বরকতময় এবং সমগ্র জাহানের জন্য হেদায়ত। এতে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি, যেমন মকামে ইবরাহীম। আর যে ব্যক্তি এর ভেতরে প্রবেশ করে, সে হয় নিরাপদ। আর এ ঘরের হজ্ব করা হল মানুষের ওপর আল্লাহ্র প্রাপ্য, যার ওই পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য রয়েছে। আল্লাহ্ সমগ্র জাহান থেকে প্রয়োজন মুক্ত’। যা কিছু বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার কথা পবিত্র কা’বা ঘর সম্পর্কে বর্ণিত আয়াতদ্বয়ে পাওয়া যাচ্ছে, তা হল এটি পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম ঘর, যেটি মক্কা নগরীতে অবস্থিত, তা অতি বরকতময়, সমগ্র জাহানের জন্য হেদায়ত। সমগ্র বিশ্বের মুসলমান নরÑনারীর জন্য এ ঘর এক ভিন্ন রকম কেন্দ্রীকতা রক্ষা করে। নামাযের ও হজ্বের ক্ষেত্রে এটাই মূল কেন্দ্র। এ কা’বাকে কেন্দ্র করে অনেক কুদরতের নিদর্শনাদি বিদ্যমান। তন্মধ্যে বিশেষভাবে একটির উল্লেখ হয়েছে। অনেক তাফসীরকার বলেন, ‘অনেক নিদর্শন’র তাফসীর হল এই একটি নিদর্শন ‘মকামে ইবরাহীম’। বহু’র ব্যাখ্যা একটি দিয়ে করা হয় কীভাবে? উত্তরে বলা যায়, এটি একের ভেতর অনেক। কারণ, তাফসীর’র গ্রন্থসমূহে এ মকামে ইবরাহীম’র একাধিক মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে এর বর্ণনা প্রসঙ্গে। ‘মকাম’ শব্দের অর্থ দাঁড়ানোর স্থান। এখানে দাঁড়িয়ে ইবরাহীম (আ.) কাবা ঘরে গাঁথুনি উত্তোলন করেছিলেন। যা সুরা বাকারার ১২৭ এবং সুরা হাজ্ব’র ২৬তম আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। এ ঘটনার স্মারক হিসাবে এ পাথর খ-টির নাম হয় ‘মকামে ইবরাহীম’। মকামে ইবরাহীম একটি মাত্র পাথর, অথচ ধারণ করে আছে আল্লাহ্র অনেক কুদরতের নিদর্শন, আর নবী খলীলুল্লাহ্ (আ.)র একাধিক মু’জিযার চিহ্ন। তাই এটি এক হয়েও অনেক। কা’বা শরীফ পুণঃনির্মাণকালে আল্লাহ্র পয়গম্বর ইবরাহীম খলীলুল্লাহ্ এ পাথরে দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। নির্মাণের উচ্চতা অনুযায়ী এ পাথর স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপরে উঠে যেত। আবার নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োজনে নিচে যেতে হলে তা আপনিই নেমে যেত। অটো সিস্টেম লিফট’র মত এ মহান কাজে পাথরটি ব্যবহৃত হয়। এটা একটি বড় নিদর্শন। পাথরের ওপর দীর্ঘক্ষণ শ্রমসাধ্য নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পায়ে ফোসকা পড়ার কথা। কিন্তু পয়গম্বরকে আল্লাহ্ তাআলা বিশেষ ব্যবস্থায় রক্ষা করেন। যে খলীলুল্লাহ্কে আল্লাহ্ নমরূদের অগ্নিকু-ে ও পুষ্প পেলব ব্যবস্থা দিয়েছেন, তাঁকে এখানেও মু’জিযা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন। পাথর খ- তাঁর পদতলে মোমের মত নরম ও আরামদায়ক হয়ে বিনয় বিগলিত হয়ে পড়ে। নিদর্শন স্বরূপ সে পাথরে তাঁর পদচিহ্ন বসে যায়। এ আরেক নিদর্শন। আর কয়েক সহ¯্র বছর ধরে অদ্যাবধি সে পদচিহ্ন পাথর গায়ে অঙ্কিত হয়ে থাকাও আরেকটি নিদর্শন।
পবিত্র কুরআনের দু’স্থানে সরাসরিভাবে ‘মকামে ইবরাহীম’র উল্লেখ পাওয়া যায়। ১. সুরা বাকারার ১২৫নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন আমি কা’বা ঘরকে মানুষের জন্য বানালাম প্রত্যাবর্তন স্থল এবং শান্তির নিলয়, আর তোমরা মকামে ইবরাহীমকে (নামাযে) দাঁড়ানোর জায়গা বানিয়ে নাও। আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে নির্দেশ দিলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই’তিকাফকারী এবং রুকুÑসাজদাকারীদের জন্য পবিত্র রেখো।’
২. অপরটি হল সুরা আÑলে ইমরান’র ৯৬তম আয়াত, ইতোপূর্বে যার পূর্ণাঙ্গ তর্জমা উদ্ধৃত হয়েছে। এটা ছিল কা’বা গৃহের চারপাশে থাকা কুদরতের চিহ্ন ও নিদর্শনাদির প্রসঙ্গ সংশ্লিষ্ট।
খানায়ে কা’বার সাথে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র ছিল এক অবিচ্ছেদ্য আত্মার সম্পর্ক। পূর্বে এ প্রসঙ্গ বিস্তৃতি পেয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ একান্তভাবে চেয়েছিলেন কা’বা শরীফই তাঁর উম্মতের জন্য ক্বিবলা স্থির করা হোক। সুরা বাকারার ১৪৪তম আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। তাফসীরে জুমাল ও খাযিন’র বরাত দিয়ে সদরুল আফাযিল হাকিম সায়্যিদ নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রহ.) সুরা বাকারার ১২৯তম আয়াতের টীকায় দীর্ঘ এক মাসআলার উদ্ধৃতি দেন। তাতে ইমাম বগভী (রহ.)’র বর্ণিত এক হাদীস’র একস্থানে রয়েছে, ‘আমি হলাম হযরত ইবরাহীম (আ.)র দুআ, হযরত ঈসা (আ.)র সুসংবাদ, আর আমার আম্মাজানের সে স্বপ্নের ব্যাখ্যা, যা তিনি আমার শুভজন্মের সময় অবলোকন করেন। এ হাদীসে ইবরাহীম (আ.)’র দুআ বা প্রার্থনা বলতে ওই প্রার্থনার কথাই বুঝানো হয়েছে, যা আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ আয়াতের এক আয়াতে পূর্বে বলা হয়েছে, ‘যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আলাইহিমাস সালাম) কা’বা ঘরের ভিত্গুলো উঠাচ্ছিলেন তারপরেই উক্ত প্রার্থনার প্রসঙ্গ বিস্তৃত হয়ে আখেরী নবী আগমনের প্রসঙ্গ প্রার্থিত হয়। আর সে সময় শেষনবী হযরত ইসমাঈল (আ.)’র পৃষ্ঠদেশে অবস্থানরত। এমন হওয়া বিচিত্র কি যে, নূরে মুহাম্মদী (দ.)’র সম্মানার্থে মকামে ইবরাহীম’র পাথুরে অস্তিত্ব ভক্তি-বিগলিত, নরোম হয়ে যায়, আর পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আ.)র পবিত্র পদচিহ্ন নিজ বুকে ধারণ করে বিশ্বের বিস্ময় হয়ে রয়?
এভাবে সাব্যস্ত হয়, ‘একের ভেতর অনেক’। ইবরাহীম (আ.)’র চরণ বুকে ধারণ করে এ পাথরটির যদি হয় এ অতুলনীয় মর্যাদা, তবে মে’রাজের বাহন বুরাক, রফরফ, মসজিদে নবভীর রিয়াদুল জান্নাহ্’র মর্যাদা কেমন হবে? নবীর প্রেমিক উম্মতদের শিরে খচিত নক্শে না’লাইন’র বরকত কেন অনস্বীকার্য নয়?
লেখক : আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা। খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।