ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান 

সাধন সরকার :

প্রত্যেক মানুষই তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে প্রিয় মাতৃভূমিকে। এককথায়, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা প্রত্যেক মানুষের কাছে পরম প্রিয় বিষয়। বাঙালি জাতি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলন-বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা করেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব, অতঃপর রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়, বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্বাধীনতার পরেও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালির স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল!

১৯৪৭ সালের আগেই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবির কথা উঠলেও তা জোরালো ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম এবং বাঙালির জেগে ওঠার আন্দোলন হলো ভাষা আন্দোলন। ভারতবর্ষ ভাগের পর পাকিস্তানের দুটো প্রদেশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ভাষাসহ অন্য সব ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সব ধরনের নিপীড়ন, বৈষম্য ও বঞ্চনায় অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার জনগণ প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়। ১৯৪৭ সালে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন যুবক ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ সাথে বাংলা ভাষার দাবির স্বপক্ষে স্বাক্ষর গ্রহণ অভিযানে অংশ নেন এবং ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার- ঐতিহাসিক দলিল’ নামক একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করা হয়। ওই ইশতেহারে ২১ দফা দাবির দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। এই পুস্তক প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন এটির অন্যতম স্বাক্ষরকারী।

১৯৪৮ সাল থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের দাবি জোরদার হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবি ছিল। এই দাবির মধ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি ছিল  অন্যতম। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন গণপরিষদের অধিবেশনে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। তার মন্তব্যে পূর্ব বাংলায় নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষা বিরোধী পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের কার্যক্রম সম্পর্কে জাতির পিতা সদা সতর্ক ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে বাংলা ভাষার আন্দোলন গতি পেতে থাকে।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয় এবং এই হরতালের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এই হরতাল তথা ধর্মঘট থেকে শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিবসহ অন্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির সুবাদে শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ সভা করতে চাইলেও সেখানেই পুলিশ বাধা দেয়। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব ১৭ মার্চ ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। ১৯ মার্চ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ¯্রষ্টা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বলেন, ‘উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একদল ছাত্র (ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মতিনসহ অন্য ছাত্ররা) তাৎক্ষণিকভাবে ‘নো’ ‘নো’ বলে  চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায়। বাংলা ভাষার আন্দোলন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ ব্যাপকমাত্রায় কাজ করে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ বছর বয়সে ভাষার অধিকার আদায়ে ন্যায়সঙ্গত সব আন্দোলনে জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যেতে থাকেন।

১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুরে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান।

১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরে জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে জনসভা শেষে বঙ্গবন্ধু ভুখা মিছিল বের করেন (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোচনামচা-২০১৭, পৃষ্ঠা-০৫)। ওই মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফলে স্বাভাবিক কারণেই ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ দিতেন।’

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ববঙ্গের রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। শাসকগোষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা ভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতা ও অপরিমাণদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে মিছিলে পুলিশি নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিকসহ আরো অনেক ভাষাবীর। মুহূর্তেই ঢাকার রাজপথ ভাষা শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে। এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু জেলে অনশন শুরু করেন। অবশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়! ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনে বিশাল মিছিলে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই মিছিল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং দৃঢ় কণ্ঠে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আইনসভার অধিবেশনেও শেখ মুজিব বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন।

আন্দোলনের পরও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে গেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির পিতা জাতিসংঘে বাংলায় প্রথম ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে বিশে^র দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলা ভাষায় চালু, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু তাঁরই নেতৃত্বগুণেই সম্ভব হয়েছে। ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখেন। মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাথার ইতিহাস দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিশে^র প্রতিটি স্বাধীন দেশে অর্থাৎ ১৯৩টি দেশে পৌঁছে গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ইউনেসকো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সারাবিশে^র মানুষের ন্যায় ও সত্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম উৎস! আজ বিশে^র ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলা ভাষার মর্যাদাই শুধু প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দেশ ও জনগণের অধিকার আদায়ে তিনি সবসময় মানুষের পাশে থেকে মুক্তিদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই বাংলা একাডেমিতে প্রথম বইমেলা উদ্বোধন করেন। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ তিনি অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ জারি করেন। জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তারই দেখানো পথে দেশ এগিয়ে চলেছে। মাতৃভাষা চর্চায় ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনির্মিত মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ভবন উদ্বোধন করেন। যেখানে বিশে^র সকল ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা, চর্চা, বিকাশ ও সংরক্ষণে কাজ করা হচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা হবে বাংলা।

লেখক : পরিবেশকর্মী