বাবুই পাখির বাসা ও রাখির কান্না

তারিকুল ইসলাম সুমন :

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা। এখানকার একটি গ্রামের নাম ভৈরবপাশা। সবুজ শ্যামল আর পাখিডাকা এ গ্রাম। দেখলেই যে কারো প্রাণ শীতল হয় যায়। বিস্তৃত সবুজ মাঠে ঢেউ খেলে সবুজ ধান। আইলের কোণে- কোণে কলমির ডালে হাসতে থাকে ফুল। বিলের মাঝে-মাঝে আঁকাবাকা মেঠোপথ। মেঠোপথের দুপাশে ঘন তালগাছের সারি। এ যেন এক ছবি আঁকা গ্রাম।

রোজই মাঠে আসে রতন। ও এবার ফাইভে পড়ছে। ইশকুল থেকে ফিরে একটু ঘুমায়। তারপর সোজা তালতলার মাঠে। লবণচোরা খেলার আসর জমে খুব। চারিদিকে ধানখেত।মাঝখানে উঁচু এই মাঠ। মাঠে আসার সময় পথ আটকে রাখে ছোটবোন রাখি। রাখির বয়স এবার পাঁচ ছুঁই-ছুঁই। রাখি রতনের খেলায় কোনো বাধা হয় না। রতন খেলতে থাকে। রাখি তখন বাবুই পাখির বাসা দেখে। খুব সুন্দর পাখি বাবুই। কী সুন্দর বাসা বোনে! কোনো-কোনো বাসায় বসে থাকে ওরা। মুখটা থাকে বাসার দরজায়। বাতাসে নড়তে থাকে বাসা। ওরা কি দোল খায়! দেখে দেখে দোল খায় রাখির কচিমন।

এভাবেই দিন পার হতে থাকে। করোনার প্রকোপ চলছে। ইশকুল বন্ধ। রতনদের খেলার সময়টাও একটু বেড়েছে। সবুজ মাঠেরও পরিবর্তন এসেছে। সবুজ গাছগুলি এখন আর সবুজ নেই। অনেকটা হলুদ রঙের। মাথা নুয়ে পড়েছে পাকতে থাকা ধানের বাইল। মাঝেমধ্যে দু-একটি বাবুই নিচে নেমে আসে। ধানগাছের ওপর বসে। দু-একটি ধান মুখে নিয়ে আবার উড়ে ফিরে বাসায়। এসবই দেখে রাখি। কী সুন্দর পাখি বাবুই। কোনো-কোনো বাসায় খাবার মুখে ফেরে মা বাবুই। নিশ্চয়ই ছানা আছে ওখানে। হ্যাঁ, আছেই তো।

সেদিন আচমকা এক বাতাস আসে। বৈশাখ মাস এসেছে, এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। খুব শুকনো একটি বাসা তালপাতা থেকে খুলে পড়ে নিচে। এক  দৌড়ে বাসাটি হাতে তুলে নেয় রাখি।

এতদিন সে বাবুই বাসা দূর থেকে দেখেছে। খুব আনন্দ পায় বাবুইবাসা ছুঁয়ে দেখে। এক দৌড়ে রতনের কাছে যায়Ñ

দেখ-দেখ ভাইয়া, কী সুন্দর বাসা!

কোথায় পেলি?

ঐ যে, ঐ গাছটা থেকে খুলে পড়েছে।

ডিম ছিল?

না ভাইয়া।

বাচ্চা?

না।

ইশ! ভাগ্যিস ছোট বাচ্চা ছিল না। ওটা কাছে রাখ আম্মুকে দেখাবি।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নেড়ে-নেড়ে সে দেখে বাসাটি। তবু যেন মন ভরে না রাখির। লাল বিকেলে রতনের পিছু-পিছু বাড়ি ফেরে রাখি।

সেদিন শুক্রবার বিকেল। জালাল সিকদার আসে তালতলার মাঠে। সাথে তার বাড়ির কাজের লোকটি। লম্বা বাঁশের লগি। লগির মাথায় কিছু খড় বাঁধতে থাকে। উৎসুক ছেলেরাও ছুটে আসে খেলা ফেলে। খড়ের মাথায় আগুন দেয়। লগির আগুন নিয়ে ছুঁইয়ে দেয় বাবুইদের বাসা। তালগাছে জ্বলতে থাকে আগুন। বাবুই পাখিরা তার জমির ধান খায়, তাই এই ব্যবস্থা!

পুড়ে যায় বহু বাবুইর বাসা। নিচে পড়েও জ্বলতে থাকে। একটু পর তালের মাঠ ছেড়ে চলে যায় পাষ- জালাল শিকদার। শিশুরা তখন বাসা থেকে বেরিয়ে আনে তেত্রিশটি পোড়া বাবুইয়ের ছানা। কি অমানবিক! হাউমাউ করে কেদে ওঠে রাখি। যেন পুড়ে যেতে থাকে রাখির কচি মন। কাছে এসে চোখের পানি মুছে দেয় রতন। বলে, কাঁদিস না বোন। ওরা আবার বাসা বাঁধবে, তখন আবার দেখিস ওদের।