বান্দরবানের গহীনে ‘জঙ্গির কবরে’ লাশ মেলেনি, নানা প্রশ্ন

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বান্দরবানে পাহাড়ের গহীনে সশস্ত্র দল ‘কেএনএফ’বা ‘বম পার্টি’র আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র এক সদস্য ‘নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে খুন’ হয়েছেন এমন তথ্যের ভিত্তিতে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করতে গিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন। কিন্তু সেই কবরে লাশ মেলেনি; মিলেছে কম্বল। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। খবর বিডিনিউজের।

পুলিশের রিমান্ডে থাকা দুই জঙ্গি জিজ্ঞাসাবাদে সংগঠনটির আরেক সদস্যকে খুন করার তথ্য দেয়। তারপর দুই জঙ্গিকে নিয়ে রুমা উপজেলার রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গম মুয়ংমুয়াল পাড়ায় গিয়ে ‘কবর’ শনাক্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রোববার আদালতের নির্দেশে সেই কবর খুঁড়ে কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানান রুমা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামুন শিবলী।
সোমবার সকালে তিনি বলেন, ‘কবরে তার মরদেহ উত্তোলন করতে গিয়ে সেখানে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। তবে কবর দেওয়ার জায়গায় যে সামান্য কিছু আলামত পাওয়া গেছে সেটি নিয়ে আসা হয়েছে।’

রুমা থানার ওসি আলমগীর হোসেন সকালে বলেন, একজন এসআইসহ দুই পুলিশ সদস্যকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছিল। তাদের দেওয়া তথ্য হল, কবর খুঁড়ে মরদেহের পরিবর্তে একটি কম্বল পাওয়া গেছে।

‘ধারণা করা হচ্ছে, কয়েকদিন আগে ওটা খোঁড়া হয়েছে, মাটি দেওয়া হয়েছে। এটা যে নতুন, শুরু থেকে বোঝা যায়।’

১২ জানুয়ারি র‌্যাব জানায়, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের আরও পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জঙ্গিরা রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহীন পাহাড়ে সশস্ত্র দল ‘কেএনএফ’ বা ‘বম পার্টি’র আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিল।

গ্রেফতার জঙ্গিদের মধ্যে চারজন হলেন নোয়াখালীর নিজামুদ্দিন হিরণ ওরফে ইউসুফ (৩০), সিলেটের সাদিকুর রহমান সুমন ওরফে ফারকুন (৩০), কুমিল্লার সালেহ আহমেদ ওরফে সাইহা (২৭) ও বায়েজিদ ইসলাম ওরফে মুয়াছ ওরফে বাইরু (২১)। এবং বাকি একজন কুমিল্লার কিশোর (১৭)।

পরে তাদের জিজ্ঞাবাদের জন্য রিমান্ডে পায় পুলিশ। তখন দুই জঙ্গি ‘নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে একজনকে খুন করে কবর দেওয়ার’ কথা জানায়।
সেই সূত্র ধরেই মরদেহের খোঁজে শনি ও রোববার অভিযান চালানো হয়। অভিযানে সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু কবরস্থানে কোনো লাশ না পাওয়ায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

তারা বলছেন, কবরস্থান থেকে লাশ কোথায় গেল? তাহলে কী কাউকে খুন করা হয়নি? এমনও হতে পারে খুন করে মরদেহ কবর দেওয়া হয়েছে কিন্তু পরে লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে? কিংবা জঙ্গিরা এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্বন্দ্বে ফেলার জন্য কৌশলে নাটক করেছে।

মুয়ংমুয়াল পাড়া এলাকাটি খুবই দুর্গম। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে শনিবার প্রস্তুতি নিয়েও সেখানে যেতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য রোববার পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হয়।

এলাকাটি রুমা উপজেলার মধ্যে হলেও যাওয়ার সহজ পথ থানচি উপজেলা হয়ে। রুমা উপজেলার উপর দিয়ে ঘটনাস্থলে যেতে হলে এক থেকে দেড় দিন সময় লেগে যায়। ফলে দলটি থানচি হয়ে যায়। অভিযান শেষ করে রাতে থানচি উপজেলা সদরে ফিরে দলটি।

ঘটনাস্থলে যাওয়া রুমা উপজেলার ইউএনও মামুন শিবলী বলেন, থানচি-লিক্রি সীমান্ত সড়কের ২২ কিলোমিটার এলাকা থেকে দেড় ঘণ্টার মতো হাঁটতে হয় মুয়ংমুয়াল পাড়া পর্যন্ত। সেখান থেকে হেঁটে আবার কবরস্থান পর্যন্ত পৌঁছাতে লাগে আরও দুই ঘণ্টা।

‘কবরস্থানে পৌঁছাতে পাহাড় থেকে রশি ধরে নামতে হয়েছে। কবর খোঁড়ার সময় পুলিশ, র‌্যাব, সেনা সদস্যসহ মোট ২০ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘আদালতের স্পষ্ট আদেশ ছিল, মরদেহ উঠাতে হবে। যারা জঙ্গি ছিল, তারা কবরস্থান দেখিয়ে দেবে। তারা দেখিয়ে দিয়েছে। কবর খোঁড়া হয়েছে কিন্তু মরদেহ পাওয়া যায়নি। সেখানে সামান্য কিছু আলামত ছিল এগুলো নিয়ে আসা হয়েছে। যদি শনাক্ত করার মত কিছু হয়।

লাশ পাওয়া যায়নি, তাহলে কী আগেভাগেই জঙ্গি বা অন্য কেউ মরদেহটি সরিয়ে ফেলেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে রুমা থানার ওসি আমলগীর হোসেন বলেন, ‘সেখান থেকে কোনো লাশ সরানো হয়নি। এটা একটা ভুয়া হতে পারে।

‘এটা একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে জঙ্গিরা নাটক করেছে এমন হতে পারে। বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা বা উদ্দেশ্যও তাদের থাকতে পারে। তবে সেখানে এরকম কিছু পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। তা না হলে সেখানে কবরের মত কিছু একটা করা হবে কেন?’

ওসি বলেন, ‘তবে এমনও হতে পারে যার কথা (নিহত জঙ্গি) বলা হচ্ছে, তাকে মেরে মাটিচাপা দিয়েছে। তারা হয়ত চিন্তা করেনি যে, এত দুর্গম এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছাতে পারবে। হয়ত তারা ভেবে নিয়েছে সে তো মরেই গেছে তাকে আর খুঁজবে না।’

ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করতে রোববার সকালে হেলিকপ্টারে রুমার রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুয়ংমুয়াল পাড়া পর্যন্ত যান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মইন।

সেখানে র‌্যাবের এই মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, কুমিল্লা থেকে একই সময়ে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়া ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরে সঙ্গে আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন নামে যিনি নিখোঁজ ছিলেন কবরস্থানটি তারই। ১৭ বছর বয়সী কিশোর ওই জঙ্গি তার কবরস্থানটি দেখিয়েছেন। মরদেহ উত্তোলন দলটির সঙ্গে নিহত আল আমিন বাবাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

‘রুমা ও থানচি থেকে গ্রেফতার হওয়া পাঁচ জঙ্গির ছয়দিনের রিমান্ডে আছে। এক জঙ্গি (১৭ বছর বয়সী কিশোর) স্বীকার করে, ২৫ নভেম্বর প্রশিক্ষণরত অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে আল আমিন নামে এক জঙ্গি মারা গেছেন। পাহাড়ের গহীনে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে।’
মরদেহ উত্তোলন দলটির সঙ্গে থাকা আল আমিনের বাবা নুরু হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আসল পরিবেশটা কী তা আজকে এসে দেখলাম। ঘটনাস্থলে ডেকচি, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটি দেখে মনে হচ্ছে এই গহীন অরণ্যে তারা (কেএনএফ) কোনো একটি গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

‘এটা খুব দুর্বিষহ জীবন। মৌলবাদীর সঙ্গে যারা ইসলামকে অপপ্রচার চালিয়ে ভুল ব্যাখা দিয়ে সরকার ও জাতির বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দিয়ে ভুল পথে ধাবিত করেছে তাদের বিচার চাই।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র‌্যাব।

জঙ্গিদের পাহাড় যোগের এ তথ্য পাওয়ার ওই সময় থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলায় যৌথ অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব ও সেনা সদস্যরা। পরে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও।

যৌথ বাহিনীর এ অভিযানে এ পর্যন্ত নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ১২ জন সদস্য এবং কেএনএফের পাহাড়ে যারা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত তাদের ১৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এর আগে গ্রেফতার সদস্যদের বরাতে র‌্যাব ২১ অক্টোবর জানিয়েছিল, কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ এর প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের সাথে ২০২১ সালে জামাতুল আনসারের আমিরের সমঝোতা হয়।

পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফ’র ছত্রছায়ায় জামাতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয় বলে সেদিন জানানো হয়েছিল।
সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে জামাতুল আনসার।

সবশেষ অভিযানে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারাও এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সেখানে প্রশিক্ষণে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ প্রশিক্ষণ শেষ করে বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন।