বাংলাদেশে চিড়িয়াখানার হরিণ, ময়ূর বিক্রি হচ্ছে

যেসব শর্ত মানতে হবে

চিড়িয়াখানায় হরিণের সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুন।

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত পশু পাখি বিক্রি ও বিনিময় করতে শুরু করেছে।করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস বন্ধ রয়েছে ঢাকার মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা। যা এখন পর্যন্ত খোলা হয়নি। এই বন্ধের মধ্যে যে চিড়িয়াখানায় যেসব প্রাণীর জন্ম হয়েছে এবং যত সংখ্যক প্রাণী বিক্রি হয়েছে তা গত পাঁচ বছরের হিসাবে রেকর্ড বলে জানিয়েছেন চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ।

প্রাণীর সংখ্যা কেন বেড়েছে?

তিনি জানান, দীর্ঘসময় চিড়িয়াখানা ও এর আশেপাশের এলাকায় মানুষের কোলাহল না থাকায় নিরিবিলি পরিবেশে প্রাণীরা নির্বিঘ্নে সঙ্গীদের সাথে সময় কাটিয়েছে। দর্শনার্থীরা না আসায় এই প্রাণীদের কেউ উত্ত্যক্ত করছে না। প্রাণীগুলো ফুরফুরে মেজাজে আছে। এ কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সব প্রাণীর যৌন আকাঙ্ক্ষা ও প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে। প্রাণীরা বেশি বেশি বাচ্চা জন্ম দিচ্ছে ও ডিম পাড়ছে বলে জানান মি. লতিফ।তিনি ১০ মাস আগে চিড়িয়াখানার পরিচালক পদে যোগ দেন।

এই সময়ের মধ্যে প্রাণীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাবার ও শাবকদের যত্নের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কারণেও প্রজনন ক্ষমতা আগের চাইতে অনেক বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

তার মতে, “প্রাণীদের যত্ন নেয়ার কারণে তাদের ইমিউনিটি ভাল আছে, রোগবালাই নেই, তাই তারা সুস্থ বাচ্চার জন্ম দিচ্ছে। আমরা বাচ্চাগুলোকেও নার্সিং করছি। ডিমগুলো আধুনিক ইনকিউবেটরে ফোটানো হচ্ছে। এজন্য প্রতিনিয়ত প্রাণীর সংখ্যা বাড়ছে।”

কী পরিমাণে বেড়েছে?

এমন উপযুক্ত পরিবেশে চলতি বছরে ইমো পাখি বাচ্চা দিয়েছে ২২টির মতো। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরল প্রাণী ইম্পালা দুটি বাচ্চা দিয়েছে। জলহস্তীর ধারণ ক্ষমতা আটটা থাকলেও সেগুলো বংশবৃদ্ধি করে ১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। জেব্রার ধারণ ক্ষমতা চারটা হলেও এখন সেটি বেড়ে হয়েছে সাতটি। বানরের সংখ্যাও প্রচুর বেড়েছে।

এছাড়া চিড়িয়াখানায় হরিণের জন্য বরাদ্দ যে তিনটি শেড রয়েছে সেখানে সর্বসাকুল্যে ১৭০টি হরিণ অবাধে বিচরণ করতে পারে। কিন্তু লকডাউনের এই ছুটির মধ্যেই হরিণের সংখ্যা ৩৫০ ছাড়িয়ে গেছে। এবং প্রতি সপ্তাহে তিন-চারটি হরিণের বাচ্চা হচ্ছে।

অন্যদিকে ময়ূরের ধারণ ক্ষমতা ৮০টি হলেও খাঁচায় রয়েছে ৬০টি পূর্ণবয়স্ক ময়ূর, এবং গত আট মাসে ডিম ফুটিয়ে ১৩০টি বাচ্চা ফোটানো হয়েছে যার প্রত্যেকটি সুস্থ আছে। সম্প্রতি ময়ূরের এই বাচ্চাগুলোকে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে বলে জানান মি. লতিফ।

বিক্রির অনুমোদন আছে দুটি প্রাণীর

এভাবে অল্প সময়ের মধ্যে চিড়িয়াখানায় প্রাণীরা ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বাচ্চা প্রসব করায় এসব প্রাণী কমিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে জানান মি. লতিফ। কিন্তু বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র হরিণ ও ময়ূর এই দুটি প্রাণী বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। কারণ এই দুটির লালন পালন ও রক্ষণাবেক্ষণ অপেক্ষাকৃত সহজ। বাকি প্রাণীগুলো দেশ বা দেশের বাইরের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় অন্য প্রাণীদের সাথে বিনিময় করার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু এগুলো বিক্রির কোন সুযোগ নেই।

এ ব্যাপারে মি. লতিফ বলেন,”আমাদের প্রাণী রাখার ম্যাক্সিমাম ক্যাপাসিটি আছে। চাইলেই অল্প জায়গায় এতোগুলো প্রাণী জায়গা দেয়া যায় না। খাদ্যের বাজেট, কেয়ার টেকারের সংখ্যাও সীমিত এজন্য আমাদের বাধ্য হয়েই বিক্রি করতে হবে না হলে বিনিময় করতে হবে।”

আবার যেসব প্রাণী বিক্রি বা বিনিময় করা যাবে না সেগুলোকে প্রয়োজনে বন্য পরিবেশে ছেড়ে দেয়ার কথাও জানান তিনি। সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রজাতির ২৪৬টি বক অবমুক্ত করা হয়েছে। অতিরিক্ত বংশ বিস্তারের কারণে এগুলোকে আর জায়গা দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সাপের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। অজগর আছে ৩২টা। এগুলো অরণ্যে ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

দাম কতো, কারা কিনছেন

চিড়িয়াখানা সূত্র মতে, বিক্রির জন্য প্রতি জোড়া হরিণের দাম ধরা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং প্রতি জোড়া ময়ূরের দাম ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। আগ্রহীদের এসব প্রাণী নারী-পুরুষ জোড়া ধরেই কিনতে হবে। একটি কেনা যাবে না।

হরিণগুলোর নিয়মিত প্রজনন হওয়ায়, এখন প্রতিমাসে অন্তত ২০টি করে হরিণ শাবক বিক্রি করা সম্ভব বলে আশা করা হচ্ছে। এরিমধ্যে ৫১টি চিত্রা হরিণ বিক্রি করা হয়েছে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ চাইছেন আরও কিছু হরিণ দ্রুত বিক্রি করতে।

এসব প্রাণী কিনতে আগ্রহীদের বেশিরভাগ ধনাঢ্য সৌখিন ব্যক্তিবর্গ। কারণ এসব প্রাণীর দাম যেমন বেশি এগুলো লালন পালনের পেছনেও প্রচুর খরচ করতে হয়। সাধারণত যাদের রিসোর্ট, বাগানবাড়ি, খামারবাড়ি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিনি চিড়িয়াখানা যাদের আছে তারাই এসব প্রাণী কিনে থাকেন।

এতে বাড়ির শোভা বাড়ার পাশাপাশি আভিজাত্যের পরিচয়ও ফুটে ওঠে বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, এ পর্যন্ত চারটি নীল ময়ূর বিক্রি হয়েছে। বাচ্চাগুলো বড় হলে সেগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। মূলত সরকারি বিভিন্ন দফতরের মিনি চিড়িয়াখানা ও দর্শনীয় স্থানেই বেশিরভাগ ময়ূর বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে।এর মধ্যে রয়েছে নাটোরের উত্তরা গণভবন, বিমান বাহিনী জাদুঘর, বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশের মিনি চিড়িয়াখানা।

ময়ূর কেনার জন্য সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছ থেকে এরিমধ্যে ৩০টি আবেদন পেয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

ইনকিউবেটরে ময়ূরের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করা হয় ও পরিচর্যা করা হয়।
কাদের কাছে বিক্রি করা হয়, শর্তগুলো কী

সাধারণত যারা এসব প্রাণী লালন-পালনে সক্ষম, প্রাণীগুলোর দেখভাল করতে পর্যাপ্ত জায়গা ও আর্থিক সঙ্গতি আছে তাদেরকেই এসব প্রাণী লালন পালনের অনুমোদন দেয়া হয় বলে চিড়িয়াখানা সূত্র জানিয়েছে। নিয়মানুযায়ী দুটি হরিণ রাখার জন্য অন্তত ১০ শতক ফাঁকা জায়গা থাকতে হয়। ময়ূর রাখার জন্য কোন জায়গার পরিসীমা বেঁধে দেয়া না থাকলেও এসব প্রাণীর দেখভালের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়। সাধারণত বন বিভাগ ও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাদের প্রাথমিক কিছু ধারণা দিয়ে থাকেন।

বন্য প্রাণী পালতে গেলে বন বিভাগের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। মূলত যাদের কাছে সেই অনুমোদন পত্র বা নো অবজেকশান সার্টিফিকেট থাকে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র তাদের কাছেই প্রাণীগুলো বিক্রি করতে পারে। এই প্রাণীগুলো শুধুমাত্র লালন পালনের জন্য দেয়া হবে। এ ধরণের প্রাণী কোন অবস্থাতেই পাচার, শিকার বা খাওয়া যাবে না। হরিণ কেনার অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বন অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল সরেজমিন যাচাই করে দেখে যে, যিনি কিনবেন, তার সেগুলো লালন-পালন করার সামর্থ্য আছে কি না।

প্রাণীগুলো বেড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবার দেয়া ও পরিচর্যার সুব্যবস্থা এবং রোগবালাইয়ের থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার মতো জ্ঞান আছে নিশ্চিত হলেই তাদের অনুমোদন দেয়া হয়।

সেইসঙ্গে প্রাণীগুলো ঠিকমতো দেখভাল হচ্ছে কিনা সেটাও বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের নিয়মিত মনিটর করার কথা। সাধারণত তারা এসব প্রাণী লালন-পালনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন। স্থানীয় পশু হাসপাতালকেও যেকোনো সহযোগিতার জন্যে এ তথ্য জানিয়ে রাখা হয়।

দুই মন্ত্রণালয়ের দুই নীতি, আইনের সাথে সাংঘর্ষিক

বাংলাদেশের চিড়িয়াখানা, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ওই মন্ত্রণালয় হরিণ ও ময়ূরের মতো বন্যপ্রাণী বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনানুযায়ী এসব সব ধরণের বন্য প্রাণী বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ও বন্য প্রাণী বিক্রির কোন অনুমোদন দেয়নি।

এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান বলেন, একই বিষয়ে একটি দেশে দুই ধরণের নীতি বা আইন থাকতে পারে না। দুই মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়টি সুরাহা করা আহ্বান জানান তিনি। তার মতে, সাধারণ মানুষ যদি হরিণের মতো বন্যপ্রাণী বিক্রি করে, তাহলে অনেকে সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে রাখতে পারে।

কারণ কোন হরিণ চিড়িয়াখানা থেকে কেনা আর কোনটা বন থেকে ধরা সেটা আলাদা করার উপায় নেই। ফলে বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে তো বনের হরিণও রাখতে পারবেন।

“কেউ যদি চিড়িয়াখানা থেকে বেশি দামে হরিণ কেনে তাহলে অনেক শিকারি বন থেকে হরিণ ধরে তার কাছে কম-মূল্যে বিক্রি করতে চাইবে। এভাবে বনে হরিণের শিকার বেড়ে যাবে। এজন্য ব্যক্তি পর্যায়ে এসব প্রাণী বিক্রি করাটা উচিত নয়।” বলেন মি. খান।

এদিকে ব্যক্তি পর্যায়ে এসব বন্যপ্রাণীর সঠিক পরিচর্যা, প্রজনন ও স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা কঠিন। সাধারণ মানুষের কাছে চিড়িয়াখানার এসব প্রাণী বিক্রি নিয়ে নে কাগজে কলমে অনেক শর্ত দেয়া থাকলেও কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই মানা হয় না বলে অভিযোগ প্রাণী বিশেষজ্ঞদের। তারা জানান, যে প্রাণীগুলো বিক্রি করা হয়, সেগুলোর সঠিকভাবে নজরদারি করা হয় না। বন্যপ্রাণীর নতুন বাচ্চা হলে সেগুলোর সব তথ্য সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও সেটা হয় না।

মি. খান জানান “চিড়িয়াখানায় যদি প্রাণীর সংখ্যা বেশিও হয় সেটা উচিত হবে অন্য কোন চিড়িয়াখানা বা সরকারি সাফারি পার্কে বিতরণ বা বিক্রি করা। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এগুলো বিক্রি করার কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। আমরা অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে এর বিরুদ্ধে বলেছি। কিন্তু, কেউ নজরে নেয়নি।’ চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর অতিরিক্ত প্রাণী বিক্রি করে থাকে।

২০১৬ সালে ২১টি চিত্রা হরিণ, ২০১৭ সালে দুটি, ২০১৮ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে চারটি, ২০২০ সালে আটটি হরিণ বিক্রি করা হয়েছিল।সেখানে গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত তারা ৫১টি হরিণ বিক্রি করেছে। যা আগের পাঁচ বছরের হরিণ বিক্রির সমান।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ময়ূর বিক্রি শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। ওই বছর ছয়টি, ২০১৮ সালে ২০টি, ২০১৯ সালে ২৪টি ও ২০২০ সালে আটটিসহ মোট ৫৪টি ময়ূর বিক্রি করেছে তারা। এ বছর বিক্রি হয়েছে চারটি। আরও বেশ কয়েকটি বিক্রির অপেক্ষায় আছে।

সম্প্রতি পাখির ডিমের জন্য দুটি ইনকিউবেটর কেনা হয়েছে, এছাড়া পুরনো একটি সংস্কার করা হয়েছে। যার ফলে পাখির ডিম ফুটিয়ে বেশিরভাগ বাচ্চা সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে। প্রাণীগুলো বিক্রির এসব টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন মি. লতিফ।

সূত্র : বিবিসি বাংলা