প্রবীণ দিবস ভাবনা

লায়ন এম. সামসুল হক »

আজ ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এ বছরের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘ বৈশ্বিক মহামারির বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা।’
মহামারি কভিড-১৯ সারা বিশ্বজুড়ে যে তা-ব চালিয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যেভাবে বিপর্যস্ত করেছে, অর্থনীতির চাকা যেভাবে স্তদ্ধ করেছে, মোট কথা জীবন ও জীবিকার সকল পথ বাধাগ্রস্ত করেছে তার ধকল কাটিয়ে উঠতে বিশ্ববাসীকে আরো বেশ কালক্ষেপণ করতে হবে।
করোনা পরিস্থিতির গতি সাময়িক শ্লথ হলেও সংকট আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব কি উন্নত, কি উন্নয়নশীল ও গরিব সব দেশ আজ দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক হতে পারেনি। শঙ্কার কথা সারা বিশ্বজুড়ে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে প্রায় এক হাজার বিলিয়ন এর অধিক প্রবীণ মানুষ বিদ্যমান। সমস্যার কলেবর প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে-এই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর। দারিদ্র্যতা, একাকিত্ব, অবহেলা তাদের নিত্যসঙ্গী।
বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর “জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা” মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করে প্রবীণদের বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়। যেমন পরিবহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত, হাসপাতালে সাশ্রয়ী মূল্যে আলাদা চিকিৎসা সেবা, বাসস্থান সুবিধা ও বয়োবৃদ্ধদের বয়স্ক ভাতা প্রদান ইত্যাদি।
আশার কথা সরকার বয়স্ক ভাতা চালু করেছে তবে প্রাপকের সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণ আরো বাড়ানো প্রয়োজন।
বর্তমান সমাজ প্রবীণ বান্ধব নয়- এ কথা বলা হলে তা অমূলক হবে না। প্রবীণ বয়সে শারীরিক ও মানসিক অসুবিধাসমূহ তাঁদের কাবু করে ফেলে, তখন তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করে আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়াতে পারি না। বিষয়টি সমাজ ও রাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল হিসাবে গ্রহণ ও প্রতিপালন করতে হবে।
“দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটি” প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আমরা সাধ্য অনুযায়ী প্রবীণদের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা, সুরক্ষা প্রদানে নানা ভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তবে এই কাজ অত্যন্ত দুরূহ। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকলে প্রবীণদের জীবনে কোনদিন অনাবিল প্রশান্তি ও স্বস্তি আসবে না।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অমোঘ পরিণতি ও চরম বাস্তবতা হচ্ছে- বার্ধক্য। এই বার্ধক্য প্রবীণ নাগরিকদের ভিন্ন ভিন্নভাবে মোকাবেলা করতে হয়। সমাজ কাঠামো, পারিপার্শিক অবস্থা, অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা, বিনোদন, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা স্তর ভেদে ভিন্ন প্রকৃতির।
সুবিধা বঞ্চিত ও দুঃস্থ প্রবীণদের রয়েছে অফুরন্ত সমস্যা। নিরব কান্না ও অস্ফুট বেদনা নিয়েই তাদের কাল যাপন করতে হয়। ধনী গরিব সকল সিনিয়র সিটিজেনদের শেষ জীবনের নিঃসঙ্গতা অসহায়ত্বের বেদনা কম বেশি একজন আর একজনের অনুরূপ।
বাংলাদেশে প্রাচীন কাল থেকে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা চালু থাকার কারণে আমাদের প্রবীণরা অতীতে আর্থিক ও শারীরিক সমস্যা ছাড়া অন্য কোনরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হননি, যা আজকের ভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের কারণে সবাই উদ্বিগ্ন। বয়স্করা পরিবার ও সমাজের অংশ। তাদের সুযোগÑসুবিধার প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তাদের জীবন আনন্দময় করে তোলার দায়িত্বও সকলের। তাঁদের জন্য বয়স্ক ভাতা সম্মানজনক করতে হবে। সুযোগসুবিধাসম্বলিত বৃদ্ধ নিবাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রবীণরা যাতে স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসা সুবিধা পেতে পারেন সে জন্য পৃথক শয্যা থাকা প্রয়োজন। পরীক্ষার খরচে স্বল্পমূল্যের সুবিধা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রবীণদের যথাসম্ভব আমন্ত্রণ জানানো উচিত।
ভ্রমণ ও যোগাযোগ এবং নানা ধরণের সেবা পেতে প্রবীণদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে বিবেচনা করা দায়িত্বের অংশ হতে হবে। আদর্শ, ন্যায়পরায়ণতা ও উন্নত মূল্যবোধের প্রকাশ সমাজকে সমৃদ্ধ করে। প্রবীণরাও এতে আনন্দিত হন। প্রবীণদের আলাদা করা নয়, তাদের সাথে মিলেমিশে আনন্দময় পরিবেশ গড়ে তোলা আমাদের সকলের কর্তব্য।
এই পাহাড় সম সমস্যা মোকাবেলায় “দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটি” প্রতি নিয়ত সমাজের প্রথিতযশা প্রবীণ ব্যক্তিদের একই ছাতার নিচে আনয়ন করে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সকল প্রকার সমস্যাসমূহ সমাধানে বদ্ধপরিকর।
আমরা চাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক সংবিধানে প্রবীণদের যে সামাজিক নিরাপত্তা সন্নিবেশিত করেছেন তার সফল বাস্তবায়ন। দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের প্রত্যাশা পূরণে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে হবে – আজকে যারা রাষ্ট্র যন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের। নৈতিক ও বাস্তবতার নিরিখে সরকারের অনুসৃত নীতিমালা প্রণয়নে তাদের সব সময় প্রবীণদের সুবিধা অসুবিধাগুলো মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে পালিত আজকের এই দিনে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যেখানে যে অবস্থানে আপনি আছেন সেই অবস্থান থেকে প্রবীণ নাগরিকদের প্রতি মমত্ব ও ভালবাসা নিয়ে একযোগে কাজ করলে নিশ্চয়ই আমরা প্রবীণ বান্ধব সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে পারবো।

লেখক : জেনারেল সেক্রেটারি
দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটি-চট্টগ্রাম