প্রবল ঝাঁকুনির ভূমিকম্প

হেলে পড়েছে দুই ভবন, ‘আগামীতে আরো শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে’

ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত
ভূঁইয়া নজরুল »
নগরীর জাকির হোসেন রোডের ওয়ার্লেস মোড়ে এক ভবনের ১৮ তলায় বাস করেন কলেজ শিক্ষিকা আয়েশা বেগম। ৬ দশমিক ২ রিকটার স্কেলের ভোর রাতের ভূমিকম্পে তিনি দোলনার মতো দুলেছেন। আর ভেবেছেন আজ বুঝি জীবনের শেষ দিন। ভূমিকম্প সম্পর্কে এমনই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি।
এ ধরনের প্রতিক্রিয়া শুধু আয়েশা বেগমের নয়, সারা শহরের মানুষের। এমনকি ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ৩৪৭ কিলোমিটার দূরের ঢাকার বাসিন্দারাও ভূমিকম্পে প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ১৮৮ কিলোমিটার এবং ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৩৪৭ কিলোমিটার পূর্ব দক্ষিণ-পূর্বে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে ৬ দশমিক ২ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪২ দশমিক ৫ কিলোমিটার গভীরে সৃষ্ট হওয়া এই ভূমিকম্পটি শক্তিমত্তা নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই। রিকটার স্কেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউএসজিএস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও আরো কয়েকটি সংস্থার মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ইউএসজিএস প্রথমে তা ৬ দশমিক ১ রিকটার স্কেল ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে তা ৬ দশমিক ২ হিসেবে ঘোষণা করে। অপরদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এটিকে ৫ দশমিক ৮ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু প্রবল এই ভূমিকম্পে কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, ফেনী হয়ে ঢাকা পর্যন্ত কম্পন অনুভূত হয়েছে।
ঢাকায় থাকা দেশের ভূমিকম্প বিজ্ঞানী ড. মেহেদী আনসারী বলেন, ‘ফজরের নামাজ পড়ার সময় প্রবল এই ভূমিকম্পটির ঝাঁকুনি অনুভব করেছি। চট্টগ্রামের মানুষ আরো বেশি অনুভব করেছে। কিন্তু এতো বড় ঝাঁকুনি হওয়ার পরও কোথাও তেমন ক্ষয়-ক্ষতি না হওয়া মিরাকল ঘটনা।’
তিনি আরো বলেন, এই ঝাঁকুনিতে অবশ্যই ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার কথা। বিশেষ করে চট্টগ্রামের ৬ থেকে ৮ বা ১০ তলা উচ্চতার ভবনগুলো বেশি ঝুঁকিতে। এই উচ্চতার ভবনগুলো নির্মাণে অনেক সময় ভূমিকম্পের সহনশীলতা রক্ষা করা হয় না। আর এতে ঝুঁকিতে পড়ে এসব ভবনের বাসিন্দারা।
ক্ষয়-ক্ষতির প্রশ্নে ড. মেহেদী আনসারীর মতো অবাক হয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্পবিদ মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর অশেষ রহমত যে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। প্রবল শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে অবশ্যই বড় কিছু হতে পারতো।’
তিনি আরো বলেন, দূরত্ব ও মাটির গভীরতার কারণে হয়তো ক্ষতি হয়নি। তবে আগামীতে আমাদের জন্য এটা একটা সতর্ক বার্তা।
তবে ক্ষয়-ক্ষতি না হওয়াকে মিরাকল বলতে রাজি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. আবদুর রহমান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘দূরত্ব ও গভীরতার কারণে যে শক্তিতে চট্টগ্রামে আঘাত করেছে তাতে ভবন ভাঙার মতো শক্তি ছিল না। তবে ঝাঁকুনি ছিল। তাই হয়তো তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।’
আগামীতে হতে পারে আরো বড় ভূমিকম্প
শুক্রবার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়েছে মিয়ানমারের সেগিং ফল্ট এলাকায়। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, আন্দামান নিকোবর হয়ে আসা প্লেট বাউন্ডারিটি এই সেগিং ফল্ট এলাকা হয়ে ভারতের পূর্ব ও উত্তর দিক হয়ে নেপাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন এই সেগিং ফল্ট এলাকায় গত ২০০ বছরে শক্তিশালী (৭ মাত্রার উপরে) ভূমিকম্প হওয়ার রেকর্ড নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্পবিদ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভূমিকম্পের আগে এই এলাকায় ৫ মাত্রার আরো একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। এখন আরো বড় হলো। আগামীতে আরো শক্তিশালী ভূমিকম্প এই এলাকায় উৎপত্তি হতে পারে। আর তা হলে অবশ্যই আমাদের প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে।’
একই মন্তব্য করেন ড. মেহেদী আনসারী। তিনি বলেন, ‘১৭৬২ সালে সেন্টমার্টিনের পাশে ৮ দশমিক ৫ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্পে সুনামি হয়েছিল এবং ১৮৫৮ সালে সেগিং ফল্টের পাশে ৮ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প হয়েছিল। যেহেতু ১৫০ থেকে ২০০ বছরের মধ্যে শক্তি বের করার জন্য বড় আকারের ভূমিকম্প হওয়ার নজির রয়েছে। তাই এই অঞ্চলে হয়তো আগামীতে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হতে পারে।’
রক্ষার উপায় কি?
ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টার। এই সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. আবদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘অবশ্যই রক্ষার উপায় রয়েছে। আমাদের বিদ্যমান ভবনগুলোর শক্তিমত্তা যাচাই করে এগুলোর শক্তি বাড়ানো যাবে। ইতিমধ্যে অনেক ভবনে করা হয়েছে।’
একই মন্তব্য করেন ড. মেহেদী আনসারী। তিনি বলেন, প্রকৌশল বিদ্যায় ভবনের শক্তি বাড়ানো যায়। এখন প্রয়োজন ভবনগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করা।
চট্টগ্রাম এর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারি, এপ্রিল ও আগস্টে ৬ দশমিক ৬, ৭ দশমিক ২ ও থেকে ৬ দশমিক ৮ রিকটার স্কেলের তিনটি শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের পর গত কয়েক বছর বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প এই এলাকায় হয়নি। এখন আবার ভূমিকম্প হচ্ছে।
প্রস্তুতি কেমন আছে?
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রনজিৎ কুমার সেন বলেন, ‘ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য সরকারের পক্ষ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমানে অনেকে তা মেনে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। যার ফলে গতকালের শক্তিশালী ভূমিকম্পেও তেমন ক্ষয়-ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। এই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা হবে।’
কিন্তু দুর্যোগ পরবর্তী প্রস্তুতি কেমন আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট, রংপুর ও টাঙ্গাইলে ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। একইসাথে ২৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে ইকুইপমেন্ট কিনতে। এর পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে যেসব ইকুইপমেন্ট রয়েছে এর একটি জাতীয় তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। পরবর্তীতে যেখানে ইকুইপমেন্ট লাগবে সেই তালিকা অনুযায়ী সেই সংস্থা থেকে ইকুইপমেন্ট ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেয়া যাবে।’
হেলে পড়েছে দুই ভবন
গতকালের ভূমিকম্পে এপর্যন্ত নগরীতে দুটি ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।এরমধ্যে চকবাজার উর্দু গলিতে ছয়তলার একটি ভবন এবং খাজা রোডে চার তলার একটি ভবন। এবিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন,‘ আমরা দুটি ভবনের খবর পেয়েছি। আমাদের টিম ভিজিট করে নিশ্চিত হওয়ার পর তা ভাঙার জন্য সিটি কর্পোরেশনের কাছে পাঠাবো। পরবর্তী ব্যবস্থা সিটি কর্পোরেশন নেবে।’
উল্লেখ্য, সারবিশ্বে প্রতিবছর দুই হাজার বার ভূমিকম্প হয়। এদের মধ্যে বছরে ১০০ ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে। ছোটো-বড় ২৭টি প্লেট নিয়ে গঠিত পৃথিবী প্রতিনিয়ত গতিতে থাকার কারণে প্লেটগুলোর প্রান্তসীমায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণেই টেকনাফ থেকে হিমালয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত গঠিত হয়েছিল হিমালয় পর্বতমালা।