নৌযান ধর্মঘটে অচলাবস্থা

অলস সময় পার করছেন শ্রমিকরা- সুপ্রভাত

কর্ণফুলীর ঘাটে পণ্য খালাস বন্ধ
ধর্মঘট নিরসনে কর্মসংস্থান মন্ত্রীকে চেম্বার সভাপতির পত্র
নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের পাল্টায় মালিকদের ৬ দাবি

সুপ্রভাত ডেস্ক :
এগারো দাবিতে সোমবার মধ্য রাত থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ধর্মঘটের কারণে বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল এবং ভোগ্যপণ্য লাইটার (ছোট আকারের) জাহাজে ওঠানামা বন্ধ থাকলেও বন্দরের জেটিতে কন্টেইনার জাহাজে পণ্য ওঠানামা অব্যাহত আছে।
সাধারণত বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য নিয়ে কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘাটে নিয়ে খালাস করে লাইটারেজ জাহাজ। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম বলেন, ‘রাত ১২টা থেকে সমস্ত লাইটার বন্ধ রাখা হয়েছে। যতক্ষণ ১১ দফা দাবি মানা হবে না ততক্ষণ ধর্মঘট চলবে। দুই বছর ধরে আমাদের এ আন্দোলন চলছে।
‘সোমবার ঢাকায় বৈঠকে দীর্ঘ বৈঠকে মালিকপক্ষ রাজি হয়নি। আমাদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ। আমরা আর সময় দিতে পারব না।’
চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় এক হাজার ছয়শ লাইটার জাহাজ চলাচল করে জানিয়ে নবী আলম বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে আমাদের প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এবং সারাদেশে মোট দুই লাখ শ্রমিক আছে। আউটারে কোনো কাজ চলছে না। যে যেখানে আছে সে সেখানে অবস্থান করবে।
লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ বলেন, ধর্মঘটের কারণে বহির্নোঙ্গরে কাজ বন্ধ আছে। তবে কত লাইটারেজ আছে সেটা এখনই জানাতে পারছি না। খবর বিডিনিউজ।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজগুলো অপেক্ষায় আছে। সেগুলোর কোনোটিতেই লাইটার যায়নি। তাই পণ্য খালাসের কাজ বন্ধ আছে। তবে কয়টি জাহাজ বহির্নোঙ্গরে আছে তা জানাতে পারেননি বন্দর সচিব। ধর্মঘটের কোনো প্রভাব কন্টেইনার জেটিগুলোতে পড়েনি। সেখানে কন্টেইনারবাহী জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠানামার কাজ চলছে, বলেন ওমর ফারুক।
নৌযান শ্রমিকদের দাবির মধ্যে আছে- সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ, ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস ও মালিক কর্তৃক খাদ্য ভাতা প্রদান, বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ২০১৬ সালের গেজেট অনুসারে বেতন দেওয়া, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা করা।
নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের পাল্টায় মালিকদের ৬ দাবি
এদিকে ১১ দফা দাবিতে পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিক ধর্মঘটের পাল্টায় মালিকরা ছয় দফা দাবি তুলে ধরে বলছেন, অযৌক্তিক দাবি মেনে জাহাজ চালানো সম্ভব নয়। মঙ্গলবার বিকালে বিজয়নগর আকরাম টাওয়ার বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভা কক্ষে এই দাবি তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ধর্মঘট পালন করার উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও রিট মামলায় খাদ্য ভাতার উপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি সকল পক্ষকে মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। শ্রমিকরা তা উপেক্ষা করে ধর্মঘট করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটি সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল হক বলেন, যেখানে করোনাভাইরাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী কর্মকর্তা ছাঁটাই করা হচ্ছে বেতন অর্ধেক করা হচ্ছে। সে সময় এ ধরনের অযৌক্তিক দাবি তুলে ধরে অরাজকতার পিছনে কারো ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, মহামারীর মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পুরোপুরি দেওয়া যাচ্ছে না। তার মধ্যেই এভাবে খাদ্য ভাতার অযৌক্তিক দাবি তুলে ধরা হলে মালিকরা নিরুপায়। ধর্মঘট প্রত্যাহার করে একটি কমিটির মাধ্যমে এবং রিট মামলাটি নিষ্পত্তি করে আলোচনায় বসতে হবে।
কিছু কিছু কোম্পানির মালিক খাদ্য ভাতা দিতে রাজি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওইসব কোম্পানির জাহাজ সিরিয়াল না ধরে মাসে চার থেকে পাঁচটি ভাড়া নেয়। তাদের আয় বেশি। কিন্তু আমরা সিরিয়াল ধরে তিন মাসে একটি ভাড়া পাই।
বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে পাঁচ হাজার জাহাজ রয়েছে জানিয়ে নুরুল বলেন, যেসব কোম্পানি শ্রমিকদের খাদ্য ভাতা দেওয়ার ঘোষণা েিয়ছে, তারা এ সংগঠনের অধীনের নয়।
সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা পণ্যবাহী জাহাজ মালিকদের দাবিগুলোর মধ্যে আছে-
>> ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নীতিমালা উপেক্ষা করে চলাচলরত সিরিয়াল বিভিন্ন জেলায় কর্মরত শ্রমিকদের কম্পিউটার সার্টিফিকেট বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
>> শ্রমিক নামধারী কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী কর্তৃক জোরপূর্বক স্বাভাবিক জাহাজ চালানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নৌপথে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
>> সরকারি গেজেট মোতাবেক ২০২১ সাল পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠনের অবৈধ দাবি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
>> নৌযান শ্রমিকদের সাহায্যে সার্ভিসটি বিভিন্ন অবৈধ জাহাজ চালানো বন্ধ করতে হবে।
>> সমুদ্রে বহির্নোঙ্গর হতে অবৈধ বাল্কহেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন বন্ধ করতে হবে। এসব দাবি পূরণ না করা হলে মালিকদের পক্ষে জাহাজ চালানো সম্ভব নয় বলে তারা দাবি করেন। সংগঠনটির সভাপতি মো. ইকবাল হোসেন সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম সারোয়ার আলমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
কর্মসংস্থান মন্ত্রীকে চেম্বার সভাপতি
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্টির সভাপতি মাহবুবুল আলম নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি গতকাল ২০ অক্টোবর এক পত্রের মাধ্যমে শ্রম ও মন্নুজান সুফিয়ানের প্রতি এ আহ্বান জানান।
চেম্বার সভাপতি পত্রে উল্লেখ করেন, গত ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে নৌযান শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। লাইটারেজ জাহাজ চলাচল না করায় সারাদেশে এসব কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বন্দরে জাহাজজট এবং কন্টেইনারজট নতুনভাবে সংকট তৈরি করছে। জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম বৃদ্ধি এবং ওভারস্টের কারণে ডেমারেজ চার্জসহ পণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং সাধারণ ভোক্তাদের অতিরিক্ত মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে হবে। বিশ্ব মহামারি করোনা ভাইরাসের এ সময়ে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষ আরো চাপের মুখে পড়বে। অর্থনীতির গতিধারা পুনরুদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্যবসায়ীরা নতুন করে অস্তিত্বের সংকটে পড়ার আশংকা দেখা দেবে বলে মনে করেন চেম্বার সভাপতি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ ধরনের ধর্মঘট অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকারক। এতে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে এবং সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যাবে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাবে যা সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক উভয় পরিসরে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
করোনাকাল থেকে ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা পুনরুদ্ধারে চলমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নির্বিঘœ রাখা, বন্দরে জাহাজজট ও কন্টেইনারজট নিয়ন্ত্রণ রাখা, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারাদেশে পরিবহন স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। বিজ্ঞপ্তি