নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণের ইঙ্গিত!

সংবাদ বিশ্লেষণ »

আজ থেকে ৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রিচার্ড নিক্সন এবং মাও সেতুংয়ের মধ্যে ঐতিহাসিক করমর্দনে স্নায়ু যুদ্ধের জ্যামিতিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। চীনে রিচার্ড নিক্সন এর সপ্তাহব্যাপী এই সফর “বিশ্বকে পরিবর্তনকারী সপ্তাহ” বলে অভিহিত করেছিলেন ইতিহাসবিদরা । এটি পরবর্তীতে মস্কোর সাথে ওয়াশিংটনের সুসম্পর্ক রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

ঠিক ৫০ বছর পর ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২২, শুক্রবার বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ আগে চীনের শি জিনপিং এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এর সাক্ষাতকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নিবিড় পর্যবেক্ষনে রেখেছেন।

ইউক্রেন সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে টান টান উত্তেজনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে চীন ও রাশিয়ার এই দুই নেতার যৌথ বিবৃতি নতুন মাত্রা এনেছে।

চীনের শি জিনপিং এবং রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন যাতে পশ্চিমা বিশ্বকে “স্নায়ু যুদ্ধের মতাদর্শ পরিত্যাগ করার” আহ্বান জানানো হয়। ক্রেমলিনের প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে, পুতিন এবং শি পূর্ব ইউরোপে সম্প্রসারণবাদী মনোভাব থেকে সরে আসার জন্য ন্যাটোকে আহ্বান জানিয়েছেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্লক গঠনের নিন্দা করেছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তির (আকুস) সমালোচনা করেছেন।

পশ্চিমা শক্তিগুলির সাথে ক্রমবর্ধমান দ্বন্ধে চীন এবং রাশিয়া নিজ নিজ অভিন্ন স্বার্থ খুঁজে পেয়েছে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন। উভয় পক্ষ ন্যাটোর অধিকতর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে উত্তর আটলান্টিক জোটকে স্নায়ু যুদ্ধের মতাদর্শ পরিত্যাগ করার আহ্বান জানায়, যা অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও স্বার্থকে সম্মান করবে এবং সেসব দেশের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক নিদর্শনের বৈচিত্র্য ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে না। বিবৃতিতে এই বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

ইউক্রেনে রুশ স্বার্থের প্রতি সম্মতি জানিয়ে, চীন বলেছে যে তারা আইনিভাবে ইউরোপে দীর্ঘমেয়াদী বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রস্তাবগুলি বোঝে এবং সমর্থন করে। একই সাথে তার নিজের অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য ও নিরাপত্তা জোটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, “উভয়পক্ষ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন জোট ও বিরোধী শিবির গঠনের বিরোধিতা করে এবং এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।”

ক্রেমলিন এর বরাতে জানা যায়, শি পুতিনকে বলেছেন, “আমরা সত্যিকারের বহুপাক্ষিক আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক করতে একসাথে কাজ করছি, যা গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনা রক্ষা করবে এবং সংকট কাটিয়ে ও সাম্য রক্ষায় বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।”

২০১৩ সাল থেকে এটি দুই নেতার ৩৮তম বৈঠক। শুক্রবারের বৈঠকটি প্রায় দুই বছরের মধ্যে কোনো বিদেশি নেতার সঙ্গে শির প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। চীনা নেতা ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে দেশ ছেড়ে যাননি। চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী সিসিটিভি জানিয়েছে, শুক্রবার বিকেলে পুতিনের বিমানটি চীনের রাজধানীতে নেমে আসে। ইউক্রেন সংকট ছাড়াও শি এবং পুতিন এর মধ্যে আরো কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করেছেন। পুতিন  হলেন প্রভাবশালী বিদেশী নেতা যিনি অলিম্পিকে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন। যদিও অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, কসোভো, লিথুয়ানিয়া, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং শেষ মুহূর্তে ভারত কূটনৈতিক ভাবে এই অলিম্পিক অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। এই ব্যাপারে পুতিন লিখেছেন, “দুঃখজনকভাবে বেশ কয়েকটি দেশ তাদের স্বার্থান্বেষী স্বার্থের জন্য সম্প্রীতির ক্রীড়াকে রাজনীতিকরণের তীব্র প্রচেষ্টায় রত হয়েছে”, এই ধরনের পদক্ষেপ “চরম ভুল” বলে অভিহিত করেছেন।

গেমসের সময় শির আতিথেয়তা উপভোগ করতে অন্যান্য নেতাদের মধ্যে রয়েছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, সংযুক্ত আরব আমিরাত এর আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফার্নান্দেজ, তুর্কমেনের রাষ্ট্রপতি গুরবাঙ্গুলী বার্দিমুখামেদভ, তাজিকের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমন, উজবেক প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরজিওয়েভ, সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্ডার ভুসিক, মিশরের রাষ্ট্রপতি আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসি, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মন্ত্রী পরিষদের চেয়ারম্যান জোরান তেগেলটিজা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, কিরগিজ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি সাদির জাপারভ, কাজাখস্তান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি কাসিম-জোমার্ট টোকায়েভ, থাইল্যান্ডের রাজকুমারী মহা চক্রী সিরিন্দর্ন, পাপুয়া নিউ গিনির প্রধানমন্ত্রী জেমস মারাপে, সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকব, মঙ্গোলিয়ার প্রধানমন্ত্রী লুভসান্নামসরাই ওয়ুন-এরডেন, কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম সিহামনি এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি আবদুল্লাহ শহীদ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসুস ও বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার মহাপরিচালক ড্যারেন ট্যাং শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইতিমধ্যে বেইজিং পৌঁছেছেন।

প্রায় ২১ জন বিশ্ব নেতা গেমসকে কেন্দ্র করে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স অনুসারে এই নেতাদের বেশিরভাগই অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দেশ শাসন করেন, যার ১২ জনই স্বৈরাচারী বা হাইব্রিড শাসকের লেবেলযুক্ত।

বিশ্লেষকদের মতে, “যারা কূটনৈতিকভাবে শীতকালীন গেমস বর্জন করেছেন এবং যারা বেইজিংয়ে এসেছেন, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি যা বিশ্বকে প্রকৃতপক্ষে দ্বি-মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে”।

ইতিমধ্যে তাইওয়ান অলিম্পিকের প্রাক্কালে এই জোট গঠনেকে কূটনৈতিক অবমাননা বলে অভিহিত করেছে; যেটি অলিম্পিক চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যুক্তরাষ্ট্রও এই বৈঠকের সমালোচনা করে বলেছে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উচিত ছিল ইউক্রেনে উত্তেজনা কমানোর জন্য এই বৈঠকটি ব্যবহার করা।

দ্যা গার্ডিয়ান সিজিটিএন থেকে অনূদিত। অনুবাদ করেছেন মশিউর রহমান সেলিম।