দ্বিতীয় কিস্তি কি সহজেই মিলবে?

আইএমএফের ঋণ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ঋণের শর্ত কিছুটা শিথিল করছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড়ের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সফররত মিশন। আগামী ডিসেম্বরেই দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পাওয়ার প্রত্যাশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আমরা আশা করছি, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮১ মিলিয়ন (৬৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার) ডলার পাবো। আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফ তাদের বোর্ড মিটিংয়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
ঋণ চুক্তির ছয়টি শর্তের মধ্যে চারটি পূরণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। দুটিতে ব্যর্থতা থাকলেও দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে তা বাধা হবে না। এতে করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার রাখার যে বাধ্যবাধকতা ছিল তা আর থাকছে না। এই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ ১ হাজার ৮০০ কোটি বা ১৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকলেই চলবে। এছাড়া আগামী বছরের জুনের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। যদিও এখন প্রকৃত রিজার্ভ আছে ১৭ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম। খবর বাংলাট্রিবিউনের।
সরকারের সঙ্গে আইএমএফের বৈঠকের শেষ দিন গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে মিশনটি জানিয়েছে, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের জন্য প্রথম পর্যালোচনা শেষ করতে বিভিন্ন নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তারা ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঋণ প্রদানের শর্তে বাংলাদেশ যেসব সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে তা চ্যালেঞ্জিং। এ অবস্থায়ও সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ঋণ প্রদান করে যে সহযোগিতা করা হয়েছে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখবে আইএমএফ।
আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন কম থাকলেও আশা করা যায়, স্বল্প মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে তা বাড়বে। মধ্য মেয়াদে চার মাসের আমদানির সমপরিমাণও থাকবে এ রিজার্ভ। তবে সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশের সামনে আছে উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি।
আইএমএফ বিবৃতিতে বলেছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে বাংলাদেশকে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, অন্যদিকে দক্ষতা আনতে হবে খরচ করার ক্ষেত্রে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যে চাপ পড়েছে সাধারণ জনগণের ওপর, তা মোকাবিলায় অধিকতর মনোযোগী হতে হবে।
আইএমএফ মনে করে, ক্রমবর্ধমান অর্থায়নের চাহিদা মেটাতে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা মোকাবিলা করাও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো, পুরো ব্যাংক খাতে তদারক ব্যবস্থা বৃদ্ধি ও সুশাসন ব্যবস্থা জোরদার করলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারের উন্নয়নও জরুরি।
আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন দল সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে ১৬ দিন ধরে (৪-১৯ অক্টোবর) বৈঠক করে। দলটি বৃহস্পতিবার শেষ দিন বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে।
আইএমএফ মিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথম পর্যালোচনা শেষ হলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় কিস্তির জন্য ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ পাবে। তবে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশে আসা মিশনটি তাদের সফর সংক্রান্ত প্রতিবেদন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য জমা দেবে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালনা পর্ষদে তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।
প্রসঙ্গত, আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় এ বছরের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করে। অনুমোদনের পরপরই প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ডলার ছাড় করে। আগামী ১১ ডিসেম্বর আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আশা করা যায়, আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে কোনও বাধা হবে না। বাংলাদেশ ও আইএমএফের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তাতে, দ্বিতীয় কিস্তি টাকা পেতে আগের শর্ত অনুযায়ী ডিসেম্বর নাগাদ প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলার সংরক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা পড়বে না। এমনকি নতুন শর্ত অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলার সংরক্ষণ করতে না পারলেও দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে অসুবিধা হবে না। তিনি মনে করেন, আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব ওঠা মাত্রই অনুমোদন হয়ে যেতে পারে। তবে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনও জটিলতা সৃষ্টি না হলেই হলো। সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যও যদি ভেটো দেয় বা আপত্তি জানায়, তাহলেই কেবল আটকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। দেখা গেলো, আইএমএফের পর্ষদের ইউরোপের কোনও সদস্য বা পশ্চিমা দেশগুলোর কোনও সদস্য যদি আপত্তি জানায়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও হতেও পারে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সফরে আসা আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে নতুন শর্তের কথা জানিয়ে দেবে।
আইএমএফের নতুন শর্ত পূরণ করতে হলে আগামী দেড় মাসের মধ্যে রিজার্ভ অন্তত এক বিলিয়ন ডলার বাড়াতে হবে। আর আগামী জুনের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। অর্থাৎ আগামী সাড়ে সাত মাসের মধ্যে রিজার্ভে অতিরিক্ত আরও তিন বিলিয়ন ডলার জমা হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড.আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফ নতুন করে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা বাংলাদেশের পক্ষে পূরণ করা মোটেও কঠিন নয়। সরকার চাইলেই সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা খুব জরুরি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, অপচয় বা ডলার পাচার কমিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। সরকার ইচ্ছে করলে সাড়ে সাত মাসে শুধু রেমিট্যান্স বাড়ানোর মধ্য দিয়েই রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা সম্ভব। ড.আহসান এইচ মনসুর উল্লেখ করেন, ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা খুব জরুরি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা না থাকলে বা বর্তমান সরকারের পতন না হলে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে কোনও বাধা নেই। আর যদি নির্বাচন পিছিয়ে যায় বা নির্বাচন হতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় কিস্তি আটকে যেতে পারে।