দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন : কেমন হবে?

মোহীত উল আলম »

প্রশ্নটা করলাম উত্তরটা আমার জানা নেই বলে। তবে কিছু ধারণা আছে, যেগুলি নিয়ে এ লেখাটা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হবার পর পর সরকারি দলের মহাসচিব সাংবাদিকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন সংলাপের আর সময় নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য তফসিল ঘোষণা হবার আগে বলেছিলেন, সংবিধান মেনে সংলাপ করতে আপত্তি নেই। আবার সরকারি দল থেকে এই মতামতও এসেছে যে সংলাপ যাদের সঙ্গে হবে তারা তো সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে, তাদের সঙ্গে কীসের সংলাপ!
কিন্তু আমি এখন যে ধারণাটি প্রকাশ করতে চাইছি, সেটির পেছনে হচ্ছে প্রাক-অভিজ্ঞতার কিছুটা পুঁজি। যখন ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কৈশোরিক বয়স পার করছিলাম, তখন আয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হবার সময় আমাদের চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ি পাড়া জুড়ে ঈদের মতো উৎসব নামতো। তখন জাল ভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ব্যালট বাক্স স্টাফিং করা এই সব দৌরাত্ম্য মানুষ কল্পনাও করতে পারতো না। ভোট নিয়ে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি হচ্ছে এই ধারার যেন এটি একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মহাযজ্ঞ, যেটিতে হারি-জিতি নাহি লাজ এবং উৎসবমুখর পরিবেশ হবে নির্বাচনের ভিত্তি।
ভোট নিয়ে আমাদের লোকজসমাজের এই অভিব্যক্তি মোটেও হারিয়ে যায় নি, যদিও বলা যায় ভয়ানক কিছু ব্যত্যয় হয়ে গেছে, যে পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের প্রধান তাঁর তফসিল-ভাষণে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে নির্বাচনটিকে সর্বোতভাবে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যেন রাজনৈতিক দলগুলো সচেষ্ট হয়। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যে বারবার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিঃশর্তে সংলাপে বসার আহ্বান জানাচ্ছে, তার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আশাবাদের মধ্যে মিল আছে। অর্থাৎ, লোকজন যদি ভোটের দিন নির্ভয়ে ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’–এই নীতিতে ভোট প্রয়োগ করতে পারে তা হলে নির্বাচনটি দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে।
আপাতদৃষ্টিতে সরকারি দল ও সংসদের বাইরে অন্যতম প্রতিপক্ষ দল বিএনপির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অবস্থান যোজনব্যাপী দূরত্বের মনে হলেও কিছু প্রয়োজনীয় কথা যদি আমরা বিবেচনায় আনি তা হলে দেখব যে এই দূরত্বটুকু মিলিয়ে যাবার মতো দূরত্ব, তার বেশি নয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং সমমনা দলগুলোর অবস্থান হচ্ছে নির্বাচন হতে হবে সংবিধান মোতাবেক, যেখানে প্রাক-নির্বাচনী সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর নির্বাচিত মন্ত্রীপরিষদ দ্বারা কিছু নিয়মিত কার্য সম্পাদন করার ক্ষমতা থাকবে, আর প্রশাসন আর আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষা করার দায়িত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। বিচারবিভাগ সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থেকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করবে। কিন্তু বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো বলছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন এই পদ্ধতিতে (অর্থাৎ প্রাক-নির্বাচনী সময়ে দলীয় সরকার কর্তৃত্বে থাকা) হওয়াতে ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল বিধায় তারা তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না, এবং তফসিল ঘোষণার পর পরই তারা নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যানতো করেছেই, উপরন্তু অবরোধ ও হরতালের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। এই কর্মসূচি তারা মাসব্যাপী পালন করে যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন তফসিল ঘোষণার পর নতুন পর্যায়ে আবার আগামী ১৯ ও ২০ নভেম্বর ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, হয়তো অবস্থার পরিবর্তন না হলে আরও করবে।
আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোর প্রতিবাদী কর্মসূচিগুলো কার্যকর হচ্ছে না, এ কথা সত্য। কিন্তু গাড়ি পোড়ানোসহ সম্পদ নষ্টের কাজ চলছেই, এবং প্রাণহানিও হচ্ছে, আর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, জনজীবনকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেওয়া পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। আর ক্ষতিটা হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক। বস্ত্র-উৎপাদক বণিক শ্রেণির সংগঠনের একজন সভাপতি বলেছেন, পোশাক শিল্পে সাম্প্রতিক অরাজকতায় প্রথম সপ্তাহেই ছয় হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে। আর দ্রব্যমূল্য এত বেড়ে গেছে যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ সত্যিকারের সংকটে পড়ে গেছে। অর্থাৎ, বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট, কিংবা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়ে একটি যে বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তাও দৃশ্যমান। রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি বা সমাজ যাই বলি না কেন, দিন শেষে মানুষের জঠরজ্বালা হচ্ছে বড় বাস্তবতা।
কিন্তু বিএনপির দাবিটা মানাও কঠিন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের অনুষ্ঠানের দাবিটা সম্ভবত বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে যুগোপযোগী নয়। কারণ সংবিধান বদলাতে গেলে বা দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত সংবিধান রদ করতে গেলে এটির পুরো প্রক্রিয়াই জটিল রূপ ধারণ করবে। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ শাসনের আমলে বাংলাদেশ এতটাই ঈর্ষণীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সফলভাবে সম্পন্ন করেছে যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বমানের উন্নয়নের কাতারে এখন ৩৫তম। প্রধানমন্ত্রীর এই অফুরন্ত প্রাণশক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐশ্বরিক বরাত। আবার সংবিধান রদ করতে গেলে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হবে, ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হবে, তারও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ এটি যদি হয় যে শর্তহীন একটা সংলাপের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার সমস্তরকম নিবর্তনমূলক পন্থা প্রত্যাহার করলো, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতের আপত্তি নেই তাঁদেরকে মুক্তি দিল, আর প্রাক-নির্বাচনী মন্ত্রী পরিষদে কিছু বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে রাখলো, আর বিরোধী দলগুলোও নির্বাচনে যোগ দেবার অঙ্গিকার করলো, তা হলে ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারির নির্বাচন একটি অত্যন্ত সফল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ৩০০ আসনের মধ্যে তাঁদের শতাধিক প্রার্থী নির্বাচিত হবেন এরকম আগাম অনুমান পত্রপত্রিকায় বিশিষ্টজনেরা করেছেন। বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা তৈরি হলে, তাদের প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় লাগলে, নির্বাচন কমিশন তফসিলের সামান্য রদবদলের কথা চিন্তা করতে পারেন, তা হতে হবে অবশ্যই সাংবিধানিক সময়সীমাকে মান্য করেই।
তবে একটা বড় কিন্তু আছে। নির্বাচনী প্রধান যেভাবে বলেছেন, সেভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা নির্বাচন কমিশন রাখতে পারবে কী? আগের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনগুলোতে যে সব কর্মকর্তা পুলিশে এবং প্রশাসনে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বা তাঁদের প্রভাব ও ভূমিকা খর্ব করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি? নির্বাচনী প্রধান এমন একটা কথাও বলেছেন যে জাল ভোট, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, স্টাফিং এবং সন্ত্রাস করলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ জনগণকে নিয়ে তা প্রতিহত করবে। কথাটি স্পিরিট হিসেবে ঠিক থাকলেও, অপ্রশাসনিক কথা হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ জনগণ কারা, আর প্রতিহত মানেই হলো সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে ব্যাঘাত হবে। নির্বাচন সম্পূর্ণভাবেই এ টু জেড অনুষ্ঠিত করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে, জনগণের সমর্থন থাকবে, কিন্তু ‘ঐক্যবদ্ধ জনগণ’কে এর ধারেকাছেও আনা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, সরকারি দল যে একটি ভূমিকা নিয়েছে যে বিরোধী দলগুলো যেন কিছুই না, তা’তে মনে হয় সরকারি দল অভিন্নতার সংকটে ভুগছে। অর্থাৎ তারা বলছে সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের মধ্যে ভিন্নতা এত প্রচণ্ড ও অবধারিত যে বিরোধী দলকে তারা কোনভাবে সমকক্ষ দল মনে করছে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক রিটারিক বাদ দিলে ভিন্নতার চেয়ে অভিন্নতাই বেশি। যদি এভাবে বলি যে, প্রায় শুনি যে হাইব্রিড আওয়ামী লীগাররা দলের মধ্যেই ওঁৎ পেতে আছে এবং পত্রপত্রিকায় এদের ভূমিকার ওপর আলোকপাতও হয়েছে । কিন্তু হাইব্রিড কথাটা আসলে দ্বি-ফলার। এটা হচ্ছে সাধারণভাবে সামাজিক মানুষের চরিত্র। এরা সবসময় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকবে। এরা সাধারণ কর্মী বাহিনী বা জনগণের সঙ্গে থাকে না, এরা পদ-পদবী দখল করে ক্ষমতার বিস্তার বা সংকুচন বা প্রভাব খাটানো বা বাধা দেওয়ার জায়গাগুলোতে বসে থাকে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে কেন্দ্রবিন্দুতে যাঁরা থাকেন তাঁরা এই মোসাহেবীদের তৈরিকৃত সীমানা প্রাচীরের বাইরে দেখতে পান না। বাংলাদেশের বায়ান্ন্ন বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। এদেরকে মীরজাফর বা অমুক-তমুক বললে, সমস্যাটার সহজীকরণ হয়, কিন্তু সমস্যার গোড়ায় হাত দেয়া হয় না। কাজেই ভিন্নতার কথা না বলে, বলতে হবে যে শেখ হাসিনার সরকার যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটিয়েছে সে কথা জনগণ সদয় চিত্তে স্বীকার করে নির্বাচনী ব্যালট বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটাবে।
আমার মূল কথা হলো একটা সুষ্ঠু, নিরঙ্কুশ, নিরপেক্ষ, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের আওতায় হোক, যেটি ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সংসদীয় জীবনের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই জন্য সব রাজনৈতিক দলকে বাস্তবসম্মতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ