দুবছর পর ফিরলো জব্বারের বলীখেলা

রিমন সাখাওয়াত »

চৈত্র মাস আসলেই লিস্ট তৈরি করতাম। টমটমি গাড়ি, মাটির গরু, ব্যাংক থেকে শুরু করে হরেক রকমের খেলনা কেনার। পুরো দেড় মাস ধরে চলতো প্রস্তুতি। বাদ যেত না মেলার বিভিন্ন ধরনের খাবারও। আগের বছরে কেনা ব্যাংক ভেঙে ভাই-বোনদের কার কত টাকা জমেছে তা নিয়ে চলতো এক তর্কের খেলা। স্কুলে যাওয়ার পকেট খরচের পুরো টাকা জমিয়ে রাখা। এরই মধ্যে বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়ার বায়নাও বাদ পড়ে যেত। তাছাড়া বলীখেলা আসলে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন থেকে খেলনা কেনার সালামিও নেওয়া হতো। যা বর্তমানে দেখা যায় না। টাকা-পয়সার সকল প্রস্তুতি সেরে মেলা শুরুর দুদিন আগে থেকে বড় কাজিনদের সাথে প্রতিদিন লালদীঘি চক্কর দেওয়া। যেন মেলা প্রস্তুতির তদারকির দায়িত্বই হাতে নিয়েছিলাম আমরা। বৈশাখের ১২ তারিখে উৎসবমুখর পরিবেশে নানা, মামা-চাচাদের কাঁধে চড়ে বলি খেলা দেখতে যাওয়া। এ নগরে এমন এক শৈশব ছিল আমাদের।

বলীখেলা দেখতে যাওয়া ছিল চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বলীখেলার মঞ্চের সামনে দাঁড়ানোর জন্য দুপুর ১টার মধ্যে দুপুরের খাওয়া সেরে বেরিয়ে যেতে হতো। সময়ের হেরফের হলেই মঞ্চের কাছে ভেড়া দায় ছিল। লালদীঘির মাঠ জুড়ে নাগরদোলা, ম্যাজিশিয়ান, বায়োস্কোপ আরও কত কি। তখন দিদার বলী নামে এক পালোয়ানও ছিলেন। যিনি বারবার চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে উল্লাস করতে করতে আমাদের এলাকা দিয়ে যেতেন। এসব বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন রাসেল। ভারি হয়ে এলো তার কণ্ঠ।

একটু থেমে আবার শুরু। নানা আর নেই, মামারাও সংসারি হয়েছে। আমিও এখন চাকরিজীবী। এরপর দীর্ঘশ্বাস! গতকাল রোববার ইফতারের আগমুহূর্তে লালদীঘি জেলা পরিষদ চত্বরে কথা হয় করপোরেট অফিসার আহমেদ আলী রাসেলের সাথে। বলীখেলার মঞ্চ তৈরি দেখছিলেন আর এসব স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা বলছিলেন।
আব্দুল জব্বারের বলীখেলা নিয়ে আরও কত যে আবেগ ঝরছিল এমন অনেক রাসেলের। তারা বলছিলেন তাদের স্মৃতির কথা। গৃহিণী শামীম আক্তার বলেন, ‘এ নগরে বৈশাখ মাসে জব্বারের বলীখেলার জন্য মুখিয়ে থাকতেন না এমন মানুষের সংখ্যা নেই বললে চলে। ফজরের নামাজ পড়ে মা-খালা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনেরাও মেলায় আসতেন। দলবদ্ধভাবে তাদের সাথে মেলায় আসা হতো। সেই সময়ে শুধু নারীরাই মেলায় কেনাকাটা করতেন। এ যেন এক নিয়মই হয়ে গিয়েছিল। সূর্য মাথার উপর না যাওয়া পর্যন্ত গৃহস্থালী জিনিসপত্রের কেনাকাটা চলত। তাদের পদচারণায় মুখর থাকত মেলার পরিবেশ। হঠাৎ করেই করোনা এসে ছন্দপতন ঘটাল। এ আমেজ দেখা যাচ্ছে না এবারের মেলায়। আজ (রোববার) মেলায় এসে আনন্দটাও আগের মত পাচ্ছি না। ছোটবেলায় বলীখেলা দেখেছিলাম। সেই স্মৃতি মনে করতে পারছি না।’

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুব সমাজকে সংগঠিত করতে ১৯০৯ সালে বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর নগরের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে নিজের নামে আয়োজন করেন কুস্তি প্রতিযোগিতা। পরে এটি আব্দুল জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি পায়। করোনার প্রকোপে বন্ধ হয়ে যাওয়ার দু’বছর পর এবার জব্বারের বলীখেলার ১১৩তম আসর বসেছে।

এবার অংশগ্রহণ করছেন ১১০তম বলীখেলার বিজয়ী কুমিল্লা হোমনা উপজেলার শাহজালাল বলী ও রানার্সআপ চকরিয়ার জীবন (তারিকুল ইসলাম জীবন)। প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে কথা হয় জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও মেলা কমিটির সভাপতি জহুল লাল হাজারীর সঙ্গে।
তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘এবার আমাদের স্বল্প সময়ের আয়োজন। এরই মধ্যে দেড়শ জন বলীখেলার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন। তবে চ্যালেঞ্জিং খেলার জন্য থাকবে ১০ থেকে ১২ জন। গত আসরের বিজয়ী এবং রানার্সআপও আসছেন। দুপুর ৩টা থেকে ৫টা পযর্ন্ত বলীখেলা অনুষ্ঠিত হবে। তবে দুঃখের বিষয় হল- এটি আমাদের ঐতিহ্য হলেও বলীদের জন্য কোনো ইনস্টিটিউট নেই। দেশে এত বড় বড় স্পোর্টিং ক্লাব রয়েছে। তারা যদি নিজেদের ব্যানারে সম্মানী দিয়ে বলীদের রাখতেন তবে এ পেশা রক্ষা করা যেত। অর্থ সংকট ও প্রশিক্ষণশালার অভাবে বিলীনের পথে বলী পেশা।’

এবারের স্পেশাল আয়োজন

এবার বলীখেলার বিজয়ীদের প্রাইজমানি বাড়ানো হয়েছে। বিজয়ী পাবেন ২৫ হাজার টাকা ও রানার্স আপ পাবেন ১৫ হাজার টাকা। সাথে থাকছে ট্রফি। বলীদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ সুবিধা এবারই প্রথমবারের মত দেওয়া হয়েছে। তারা বৈশাখী মেলা ঘুরবেন বলীখেলার গেঞ্জি পড়ে। তাছাড়া এবার তৃতীয় স্থান অধিকারীর জন্য ৬ হাজার টাকা ও চতুর্থ স্থানের জন্য ৫ হাজার টাকা সংযোজন করা হয়েছে। প্রথম রাউন্ডে বিজয়ী ৫০ জন বলী পাবেন ১ হাজার টাকা করে প্রাইজ মানি।’

জানা গেছে, শেষ আসরে অর্থাৎ ১১০তম আসরে ৬২ জন বলী অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১০৯তম আসরে ৮৬ জন, ১০৮তম আসরে ৯০ জন ও ১০৭তম আসরে ৯৭ জন।

১১০তম আসরে বিজয়ী ছিলেন শাহজালাল বলী। তিনি ১০৯তম আসরের চ্যাম্পিয়ন জীবন বলীকে ২৬ মিনিটের লড়াইয়ে পরাজিত করেন। এরআগে জননন্দিত দিদার বলী ১০৮তম আসরে শেষবারের মত ১৩তম ট্রফি নিয়ে অবসর ঘোষণা করেন। এরআগে ১০৭তম আসরে দিদার বলীকে হারিয়ে বিজয়ী হন টেকনাফের সামসু বলী। তারও আগে ১০৬, ১০৫ ও ১০৪তম আসরে টানা বিজয়ী ছিলেন দিদার বলী।