দহনগানের গল্প

খায়রুল আলম সুজন »

গত মঙ্গলবার আইরিন মারা গেছে। এক সপ্তাহ পর সংবাদটি শুনে ভীষণ খারাপ লেগেছিল।এত অল্প বয়সে সে মারা যাবে, ভাবিনি। কেমন যেন কষ্ট অনুভব করছি। দিন পনেরো আগেআইরিনে মা ফোন করে অনুরোধ করেছিল, একটু হাসপাতালে আসবে বাবা, কিডনি ওয়ার্ডে, আইরিন তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। ওর দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে, এসো বাবা। এক নিশ্বাসে পুরো বর্ণনা দিতে গিয়ে কন্ঠরোধ হয়ে আসছিল তার।আমি নিশ্চুপ থেকে শুনে যাচ্ছিলাম।
দেরি করিনি। সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধু শাহিনকে নিয়ে হাসপাতালের কিডনি বিভাগে উপস্থিত হলাম। আইরিন শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। স্যালাইন চলছে। অনেকদিন পর দেখা। দারুণ সুন্দর হয়ে গেছে সে। এমনিতেই অবশ্য আইরিন আকর্ষণীয় ছিল। লম্বায় পাঁচ ফুট পাঁচ তো হবেই। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। হাল্কা পাতলা গড়ন। মায়াবী চোখ আর চুল হাঁটু পর্যন্ত। আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে, হন্তদন্ত করে বসার চেষ্টা করছিল। আমি আসবো হয়তো ভাবনাতেই ছিল না ওর। কোনো কথা না বলে আইরিনের মাথার কাছে বসলাম।
কথার শুরুটা আমিই করলাম, ‘অনেক সুন্দর লাগছে তোমায়’। চমৎকার একটা হাসি দিল। হাসপাতালের বেডে হেলান দিয়ে বসে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আরাম করে বসার চেষ্টা করছিল। ছোটবেলায় ঠাকুর মা’র ঝুলির সেই রাজপুত্রের গল্পের কথা মনে করিয়ে দিল। রাজকন্যা বারান্দায় চুল শুকানোর জন্য চুল ছেড়ে দিতো আর সেই চুল বেয়ে রাজপুত্র ওঠে আসতো রাজকন্যার সাথে দেখা করতে। যেন সেই রাজকন্যার চুল দেখতে পাচ্ছিলাম।
ক্ষীণকন্ঠে শুরু করলো আইরিন। ‘পাঁচ বছর ধরে অবহেলা-অপমান করার পর আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসলেন ?’ প্রশ্ন দিয়েই কথা শুরু করলো আইরিন। ‘আমি তো কখনও কিছুই চাইনি আপনার কাছে, কেন এত কষ্ট দিয়েছেন?’ বাবা-মা, ছোট বোন-ভাই আর ওর প্রিয় বান্ধবী তানিয়া সবাই আইরিনকে ঘিরে রেখেছে।
হুট করে চলে গেলাম অনেক আগে। আমাদের প্রেমের শুরুটা হয়েছিল ৯৪ সালে রোজার মাসে টেলিফোন ক্রস কানেকশনে। অফিসে কাজ করিছলাম। পিয়ন ওসি এসে জানালো ,স্যার মোব্বাশ্বের স্যার ফোন করেছেন। আমি উঠে ফোন ধরে কথা বলতে চেষ্টা করছি, অন্য প্রান্তের আমার বস কিছু নির্দেশনা দিচ্ছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। দুই বান্ধবীর ফোনের কথোপকথনের জন্য। অনেক অনুরোধ করলাম শুনছে না। কয়েকবার কেটে আবার ফোন করলাম সেই দুই বান্ধবীর কথা চলছেই। অনেকবার চেষ্টা করেও বসের সাথে কথা বলতে পারছিলাম না। আবার অনুরোধ করার পরেও ফোন রাখছে না। উল্টো আমাকেই কথা শুনাচ্ছিল। দুই বান্ধবীকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে দুষ্টুমির ছলে বলে ফেললাম, ‘আপনাদের কি বাপ-ভাই নাই’।
এর মধ্যে বস মোবাশ্বের ভাই জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোমার ফোন ৫০২৬৪৫ ফ্রি হয়েছে, তাহলে ঐ ফোনে কল করছি’। বসের সাথে কথা শেষ করে দ্রুত কাজ সেরে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় আমার ফোনটি কান্না শুরু করলো। রিসিভার তুলে হ্যালো বলতে মেয়েলি কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘আপনি কি সুজন সাহেব?’ জি¦ বলতেই উত্তর এলো, ‘আপনার কন্ঠ অনেক সুন্দর, সুন্দর করে কথা বলতে পারেন কিন্তু আমার মনে হয় আপনি অনেক দুষ্ট এবং মজার মানুষ’। বুঝতে পারছিলাম না কে কথা বলছে। পরিচিত কন্ঠ নয়।
-আপনি কে বলছেন ?
-এই যে কিছুক্ষণ আগে কথা কাটাকাটি করলেন তাদের একজন। আমার নাম আইরিন।
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন ?’ কোন উত্তর দিল না। ফোন রেখে দিলাম। পরের দিন সকালে এসেই পিয়ন ওসি জানাল, ‘স্যার একটি মেয়ে ফোন করেছিল। আপনি কখন অফিসে আসেন, কখন যান, বয়স কেমন ইত্যাদি জানতে চায়’।
– আপনি কি বলেছেন মি. ওসি।
এই ওসি ৪০/৪২ বছর চাকরির বয়স। অফিসের ছোটবড় সবাই একটু বাঁকা চোখে দেখে। কারণ উনি পুলিশি কাজ করেন। মানে বিগবসের ইনফরমার। অতএব ওসির কদরই আলাদা। কেহ একজন তার নাম রেখেছিল ওসি। সেই থেকে সবাই ওসি নামে ডাকে। চাকরির শুরুতে আমার ওপরও ওসি নজর রাখত। কিন্তু আমি ওইসব পাত্তা না দিয়ে বরাবরই স্বাধীন চলাফেরা করতাম। ইচ্ছামত সময়ে অফিসে আসতাম। অফিস সময়ের আগেই নাটকের মহড়ায় চলে যেতাম। অনেক নালিশ থাকতো আমার নামে কিন্তু কাজ ফেলে রাখা বা ফাঁকি দেওয়া আমার চরিত্রে নাই। অফিস ততদিনে বুঝে গেছে। এছাড়া বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানো অভ্যাস। অনেকের প্রিয়ভাজন ছিলাম। শ্বাসকষ্টে ভোগা ওসিও আমার কোনো অন্যায় খুঁজে পেত না। পারলে আমাকে নিয়ে বরং এক ডিগ্রি বাড়িয়ে বলত। আইরিনকেও তাই বলেছে মনে হয়। এরপর প্রতিদিন দুতিনবার ফোন করত। ভাগ্য ভালো ওসি তাকে বাসার ফোন নাম্বার দেয়নি। আইরিনের সাথে শুরুটা এভাবেই। ওর সাথে কথা বলাটা প্রাত্যহিক রুটিনে পরিণত হল।
তবে কাজের সময়ে ফোনে বিরক্তবোধ করা শুরু করলাম। আমার জুনিয়র কলিগদের ফোন ধরিয়ে দিতাম। এক পর্যায়ে অফিসের জুনিয়র-সিনিয়র সবার সাথে কথা বলিয়ে দিতাম। অনেকেই বকাঝকা দিত। যাতে আর ফোন না করে। আসলে ছোটবেলা থেকে মন্দকথা বলতে পারি না। তাই বিকল্প অবলম্বন অন্যকে ফোন ধরিয়ে দেওয়া।
এভাবেই চলতে লাগলো। বছর দুয়েক পর আইরিনের মা ফোন করে অনুরোধ করলো কাল ১৯তম জন্মদিন ওর। যেন অবশ্যই আসি। অনেক অনুরোধ তাই ফেলতে পারলাম না। অফিসের চারজন কলিগকে নিয়ে জন্মদিনে বাসায় উপস্থিত হলাম। বিশাল আয়োজন। বাবা-মায়ের অনেক আদরের মেয়ের জন্মদিন। বান্ধবীদের উপস্থিতিতে আনন্দমুখর পরিবেশ। বাবা দাতাসংস্থার বড় কর্মকর্তা। পরিচিত হলাম সবার সাথে। এই প্রথম আইরিনের সাথে দেখা হলো। কিছুদিন পর বাবার চাকরিসূত্রে কক্সবাজারে চলে গেল ওদের পরিবার। নিয়মিত যোগাযোগ রাখত আমার কলিগদের সাথে। চিঠি লিখত, গিফ্ট পাঠাত আমার জন্য। আমি শুধু জন্মদিনে একটি বই দিয়েছিলাম।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে পুরোনো অনেক কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অথচ মেয়েটি তখনও জানে না ওর দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গেছে। আর ঘুরেফিরে সেই এক প্রশ্ন, কেন আমি ওকে এত অবহেলা করি। আমার তো বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না। হঠাৎ বলে বসলো ‘আমি বোধ হয় বাঁচবো না। তবে ভালো লাগছে, আপনি এখন অনেক বদলে গেছেন’।
আমি অনেক দুষ্টুমি করেছি সেদিন, জোকস বলছিলাম ওকে খুশি করার জন্য। পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কিভাবে বুঝলে আমি বদলেছি? উত্তরে আইরিন বললো ‘আপনার হাত কোথায় ?’ বিস্মিত আমি লক্ষ্য করলাম, আমার হাত তখন আইরিনের চুলে সাঁতরাচ্ছিল।