তারামন বানু

ওলি মুন্সী »

ধানের ব্যবসাটা ছেড়ে দিয়েছে বলে বেকার না, কারণ গ্রামে কর্ম আর অকর্মের পার্থক্য তেমনটা নেই। আর এই ব্যবসাটা ছাড়ার কারণ দুটিÑÑ প্রথমত হলো দালালি করা মানে প্রতি মণ ধানে তিন কেজি করে বাড়িয়ে নেয়া, তার বিবেকে বেঁধেছে। দ্বিতীয়টা হলো রাস্তাঘাটের যে-অবস্থা কিছুক্ষণ পরপর খানাখন্দ। তার কারণ হচ্ছে বৈশাখের ঘনঘন বৃষ্টি। গরুর গাড়িতে করে ধান কেরি করা দুরূহ। তাই একটি সাইকেল কিনেছে। বলছিলাম নিতান্ত একটি পল্লিগ্রামের সুদর্শন যুবক হাদিসের কথা। এক বছর হলো বিয়ে করেছে পাশের গ্রামের তারামনকে। গ্রামটি তার নিজ বাড়ির পিছন থেকে দেখা যায়। সদ্য বিয়ে ঠিক। ভাতিজা ওলিকে নিয়ে চিল ঘুড়ি উড়িয়ে গান গায় … আমার সোনাবন্ধুরে তুমি কোথায় রইলা রে …
সাইকেল কেনার পর তা চালানো শিখছে ভাতিজাকে নিয়ে বাড়ির পিছনে পাড়ার একটা মাঠে। যেখানে গেলে খুব ভালো করে তারামনদের বাড়ি দেখা যায়। ভাতিজা তখন না বুঝলেও এখন বুঝে যে, এটা নিছক খাঁটিপ্রেম ছিল। সদ্যবিয়ে ঠিক হলো। তেমন দেখাজানা নেই, তবে এতো টান কিসের।
যাই হোক, এতোদিন বাবার সংসারে খেয়েদেয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেটির এখন নিজের সংসার আছে। কিছু করতে হবে দুমুঠো ডাল-ভাতের জন্য। তবে নিজের ঈমানটা হারিয়ে নয়।
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ধানের ব্যবসা আর করবে না।
জ্যৈষ্ঠমাসে পানি আসার পর একটা ডিঙি আর ধর্মপাশা থেকে মাছ ধরার … নিয়ে আসবো।
তাই করা হলো। বেশ ভালোই আয়-রোজগার হচ্ছিল।
এভাবে কয়েক বছর গত হয়েছে। কিছু ধানের জমি চাষ করে আর বর্ষা কালে মাছ ধরে।
এমন পেশার মানুষ হলেও হাদিস খ্বু সামাজিক এবং ধর্মের গোপন প্রেম তাকে প্রতিনিয়ত ইশারা করে নির্জনে।
সে আস্তে-আস্তে কর্মে অমনোযোগী হয়ে ধর্মে মনোযোগী হতে লাগলো। বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশখী সবাই অবাক হাদিসকে দেখে। কি হয়েছে তার। যে ব্যক্তির রাগে সবাই কাঁপত। যার অভ্যাস ছিল বউশাসন করা প্রচ- প্রহারে।
প্রহারের কথা যখন আসছে তারামনের কথা একটু বলেই রাখি। অসম্ভব স্বামীভক্ত ধার্মিক মহিলা।স্বামীর বিপক্ষে টু শব্দটা করতো না।
হাদিস আস্তে-আস্তে রাত্রিসাধনায় লিপ্ত হয়ে লম্বা রোনাজারি করে। কিছুদিন পর তারামনও একই হালতে। কামকাজ বলতে নেই। একটি ছেলে সন্তান। সে এখন মাদ্রাসায় লজিং। দুজন বাড়িতে থাকলেও ইদানীং হাঁড়িতে চালছাড়া চুলোয় আগুন ধরানো হয়।
শুধু শাক আর কিছু ফল খেয়ে দুবছর গত হয়ে গেল।
হাদিসের ডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। লোকজন আসে। বিভিন্ন তদবিরে কাজ হয়। সিন্নি ওঠে মানুষের স্বেচ্ছায়। এখন ভালোই ছেলেটা হাফেজ হয়েছে। যদিও বাবা ফকির কবিরাজ। তা নিয়ে আলোচনা হয়। কারণ আমাদের সমাজে পির-ওলামার সম্পর্ক আগুন-পানির মতো।
ভাতিজা ঢাকায় থাকে। ঢাকাতে হুজুরদের ইনকাম যেমন সম্মানও তেমন। ওলি ওকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে এখন আরবি প্রাইভেট টিউটর।
রমজান মাস। হঠাৎ হাদিসের শরীর খারাপ। কিছুদিন যাওয়ার পরও কোন উন্নত হচ্ছে না। বরং দিন দিন খারাপ হতেই চলেছে। সকালবেলা তার বড়ভাই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। হাদিস যেতে ইচ্ছুক না। তবুও সবার জোরাজুরিতে হাসপাতালের মাঝপথে হাদিস তার ভাইকে বলছে, ভাইছা, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে কোন কাজ হবে না। বাড়িতে নিয়ে যাও। আমার প্রতি দাবি রাখিও না। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। পারলে ক্ষমা করে দিও।
হাদিস ধীরে-ধীরে ঢলে পড়ছে তার বড়ভাইয়ের বুকের ওপর। এ কেমন নিয়তি। বড়ভাইয়ের আগে ছোটভাইয়ের মৃত্যু।
তারামন এখন শহরে থাকে গেঁয়োতা দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে। পুত্রবধূর সাথে আতীতে গিয়ে গোপনে চোখের জল মুছে।
এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার কি দরকার ছিল তোমার। ভাঙা ঘরে শুয়েই চলে গেছ। চা খাওয়ার জন্য টাকার কতো হা হতাশ। এখন কোন কিছুর অভাব নেই। একদিন দেখে যেও পাঁচতলা ফ্ল্যাটের ভিতর।
তারামন জানালার ফাঁকে তাকিয়ে দেখে ব্যস্ত শহরের পথ। যদি কোন দিন দেখা যেতো হারিয়ে যাওয়া সেই প্রিয়মুখ।