ডাইনোসরের কথা

আখতারুল ইসলাম

এমন এক সময় ছিল, যখন পৃথিবী ছিল না, ছিল না পৃথিবীতে গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ। প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি হয়। তারপর জীব। পৃথিবী ও জীব সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও সঠিক তথ্য দিতে পারেনি, এক তথ্যে বলা হয় পৃথিবী সৃষ্টির দুই-তিনশ কোটি বছর আগে, সূর্য নামক নক্ষত্রের জ্বলন্ত অগ্নিপি- থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরতে সরতে ঠান্ডা জমাট হয়ে আজকের এই পৃথিবী নামক গ্রহের সৃষ্টি। উপরিভাগ কুঁচকে উঁচু নিচু অসংখ্য পাহাড় পর্বত ও খাদ-গহ্বর সৃষ্টি হয়।

এভাবে পৃথিবীতে নদী, সাগর, মহাসাগরের উৎপত্তি লাভ করে। কয়েক কোটি বছর পরে প্রথমে জলের মধ্যে প্রাণের সৃষ্টি হয় বলে বিজ্ঞানীরা অভিমত দেয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণি অ্যামিবা, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এককোষী প্রাণি হতে বহুকোষী প্রাণের উদ্ভব। কায়েক কোটি বছর অতীত হবার পর স্থল ভাগে গাছপালার জন্ম। কোন কোন জলভাগের প্রাণি স্থলভাগে ওঠে উভচর জীবে পরিণত হল। যেমন ব্যাঙ জাতীয় প্রাণি। কালক্রমে পৃথিবী বনজঙ্গলে ভরে গেল, অবাধে চলাচলের জন্য উভচর প্রাণি টিকটিকি, গিরগিটির মত নতুন জীবে পরিণত হয়।  এরা হল সরিসৃপ জাতি। যারা সম্পূর্ণভাবে স্থলভাগে বসবাসের জীব। এথেকে অতিকায় জীবে পরিণত হয়। প্রাণিবিজ্ঞানে এদের ডাইনোসর বলে।

ডাইনোসর (অতিকায় মেসোজোয়িক সরিসৃপ) : অনেক আগের কথা প্রায় ২২০ মিলিয়ন অর্থাৎ ২২ কোটি বছর আগে যখন পৃথিবী গরম থেকে ঠান্ডা হয়ে গাছপালা পশুপাখিতে সমৃদ্ধ হচ্ছিল। ঠিক তখনই অতিকায় সরিসৃপ জাতীয় প্রাণিদের আবির্ভাব ঘটে। এর বহু বছর পর এখন থেকে ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে তাদের বিলুপ্তি ঘটে। টিকটিকি আকৃতির সেই ভয়ঙ্কর প্রাণিদের বলা হত ডাইনোসর। সবচেয়ে বড় একটি ডাইনোসর এর আকার আকৃতি ওজনে ছিল এখনকার পূর্ণবয়স্ক হাতির প্রায় দশগুণ। তবে ছোট সেনোজোয়িক যুগে ডাইনোসরদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। সে কারণে ঐ যুগকে সরিসৃপদের যুগ অমব Age of reptiles বলে। বিজ্ঞানী S.R Owen ডাইনোসর শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি এই ডাইনোসর শব্দটিকে সরিসৃপের বড় বড় জীবাশ্ম বুঝিয়েছেন অর্থাৎ ডাইনোসর আকারে বড়। এরা চার পায়ে হাঁটতে পারত। কিছু সদস্য দ্বিপদী ছিল, তাদের সামনের পা খাটো, আঁকড়ে ধরার জন্য অভিযোজিত। প্রথম ট্রিয়াসিক সময়ে আদি ধরনের থেকোডন্ট ভা-ারের আকারে উন্নতি হয় এবং সম্পূর্ণ মেসোজোয়িক মহাযুগ ধরে বিস্তার লাভ করে। প্রায় ১৫০ মিলিয়ন বছর শেষে ট্রিয়াসিক যুগ থেকে ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষ পর্যন্ত স্থল পরিবেশে ডাইনোসর প্রধান প্রাণি। জলে স্থলে শূন্যে অভিযোজিত ছিল। সিনোজোয়িক স্তন্যপায়ী বৈচিত্র্য ও বিস্তারে এদের  প্রতিরক্ষাকারী প্রতিযোগী ছিল, ধারণা করা হয় ডাইনোসর বৃহত্তম স্থলচল প্রাণি ছিল।

ট্রিয়াসিক যুগের থেকোডন্টরা ডাইনোসরের সরাসরি পিতৃপুরুষ। অধিকাংশ থেকোডন্টরা ক্ষুদ্র আকারের সরিসৃপ। বিজ্ঞানী S.R Owen এর মতে, ডাইনোসোররা আদি কটিলোসরিয়ার ভা-ার থেকে সৃষ্টি হয়েছে। ইহা কার্বোনিফেরাস যুগে উৎপত্তি লাভ করে।

ডাইনোসর-মহাকালের দৈত্য : অধিকাংশের চোখে বিলুপ্তির প্রতীক ও পরিবর্তনশীল পরিবেশে অনভিযোজিত প্রাণিগোষ্ঠী যারা পৃথিবীতে শুধু জীবাশ্মই রেখে গেছে, কোনো উত্তর পুরুষ নয়, তারাই ডাইনোসর। অবজ্ঞার চোখে দেখা এ প্রাণিগোষ্ঠীর ইতিহাস আজ বিজ্ঞানীরা নতুন করে লিখতে বসেছেন। একে একে প্রমাণিত হচ্ছে যে ডাইনোসরদের যতো বোকা ভাবা হতো আসলে ওরা তা ছিল না কৌতূহলোদ্দীপক এ প্রাণি ছিল বিশাল পরিবেশে শুধু যে অভিযোযিতই ছিল তা নয়, বরং ছিল এক উন্নত দেহতন্ত্রেরও অধিকারী। বাকের (Bakker, ১৯২৫) আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন যে ডাইনোসরেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, বরং তাদের বংশধরের এক গোষ্ঠী আজও জীবিত রয়েছে, আর তা হচ্ছে পাখি।

যা হোক, ডাইনোসর পৃথিবীর সর্বকালের সর্বাধিক আলোচিত এবং সর্বমহলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রাণিগোষ্ঠী। সাধারণভাবে মেসোযয়িক মহাকালে স্থলভাগে প্রাধান্য বিস্তারকারী বিশাল দেহের দৈত্যাকার সরিসৃপদের ডাইনোসর বলে। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ স্থলচর এ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হলেও হালকা গড়নের, খরগোস বা বিড়াল আকৃতির ছোট-খাটো সদস্যও এতে কম ছিল না।

আবিষ্কার ও নামকরণ : আবিষ্কারের প্রথমদিকে ডাইনোসরের হাড়গোড় দেখে মানুষ বিস্ময়ে অভিভূত ও বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। তখন কেউ ভেবেছে, ওগুলো মানব দৈত্যের ধ্বংসাবশেষ যাদের বংশধর আজও কোথাও না কোথাও বেঁচে আছে, কেউবা হাড়গুলোকে অস্বাভাবিক আকারের গিরগিটি মনে করেছে। কিন্তু কেউই ভাবেনি যে পৃথিবীতে এক সময় এমন প্রানী বাস করতো যারা আজ বিলুপ্তির অতল গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

প্রাচীন যুগে গ্রীস ও রোমে এবং মধ্যযুগেও পৃথিবীর নানান জায়গায় জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু কেউই তখন এসব প্রাচীন হাড়গোড়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি, জোড়া লাগানো দূরের কথা (Goodenoungh, ১৯৭৭)।

আজ থেকে তিনশ’ বছর আগে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ারে প্রাপ্ত একটি লম্বা অস্থিখন্ড দেখে লোকজন একে মানবদৈত্যের অংশ ভাবতে শুরু করে। দুশ’ বছর আগে একই কাউন্টিতে আরেকটি জীবাশ্ব উদ্ধারের পর মানুষ একে বাইবেলে বর্ণিত মহাপ্লাবনে ডুবে যাওয়া মানুষের অস্থিখ- বলে প্রচার করতে শুরু করে।

ডাইনোসরের- জীবাশ্মের প্রতি মানুষ আগ্রহ দেখাতে শুরু করে উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে। অক্সফোর্ডের ভূতাত্ত্বিক উইলিয়াম বাকল্যান্ড (Willium Buckland) ১৮২৪ সালে সর্বপ্রথম একটি ডাইনোসর-জীবাশ্মের বর্ণনা দেন। জীবাশ্মটি ছিল Megalosaurus-এর। এর পঁচিশ বছর পর ম্যানটেল (Mantell) Iguanodon-এর আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন।

প্রায় দেড়শ’ বছর আগে এসব বিশাল আকৃতির সরিসৃপীয় জীবাশ্মকে সর্বপ্রথম ডাইনোসর নামে অভিহিত করেন লন্ডনের Natural History Museum এর প্রথম পরিচালক স্যার রিচার্ড ওয়েন (Sir Richard Owen) দুটি গ্রীক শব্দ থেকে ডাইনোসর নামের উদ্ভব হয়েছে- deinos = terrible /ভয়াল + sauros = lizard / গিরগিটি অর্থাৎ এক কথায় ভয়াল গিরগিটি। ডাইনোসরকে বাংলায় ‘ভীমসরট’ বলে (হোমত, ১৩৯৯)।

আসলে ইংরেজি ডাইনোসরের চেয়ে বাংলা ভীমসরট বেশি অর্থবোধক।

কারণ ডাইনোসর অর্থ করলে দাঁড়ায় ভয়াল গিরগিটি, অথচ ওরা না ছিল গিরগিটি, না সাধারণভাবে গিরগিটির সম্বন্ধযুক্ত, অন্যদিকে ভীমসরট অর্থ ভয়াল সরীসৃপ (সরট অর্থ সরীসৃপ)। তবে ডাইনোসর শব্দটি পৃথিবী জুড়ে বহুল প্রচারিত, পরিচিত ও গৃহীত হওয়ায় আমরাও ওদের ডাইনোসর নামেই ডাকতে পারি।

সাধারণ নাম দেয়ার পর পরই অতি দ্রুত ডাইনোসর-জীবাশ্ম আহরণ এক উন্মাদনায় রূপ নেয়।

এক সময়ের অনাদৃত বিষয় তখন পরম আদরের সম্পত্তিতে পরিণত হয। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে জীবাশ্ম পাওয়া যায় যে এক রাখাল তখন নিজের জন্য ডাইনোসরের হাড় দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছিল। উটাহ্ রাজ্যে অবস্থিত বিপুলতম ডাইনোসর হাড়ের অন্যতম ‘সমাধিক্ষেত্র’টি আজ Dinosaur National Monument নামে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।

ডাইনোসরের ইতিহাস : ইংল্যান্ডের দক্ষিণে জুরাসিক ও ক্রিটেসিয়াস যুগে শিলাস্তরে ডাইনোসরের দেহ অবশেষ আবিষ্কৃত হয় এবং Buckman১৮২৪ এবং Nuctell 1925 ১৯২৫ সালে এর বর্ণনা দেন। বিজ্ঞানী SR Owen ডাইনোসরের নামকরণ ও বর্গ Dinosauria নির্ধারণ করেন এবং ১৮৭৫ সালে পূর্বে Huxleg, Philips I Coke এদের গঠন সম্পর্কে বর্ণনা দেয়। পরবর্তীতে ডাইনোসরের কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় দক্ষিণ আমেরিকা ও জার্মানিতে তা থেকে তিনটি বর্গে ভাগ করেন।

বিজ্ঞানী O.E. Mership এদেরকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন- (i) Pteropoda (ii) Sauropoda (iii) Pretonta। বিজ্ঞানী H.G. Seeley এদের দুটি দলে ভাগ করেন। (i) Saurischia (সরীসৃপের ন্যায় ডাইনোসর) (ii) Ornithischia (পাখির ন্যায় ডাইনোসর)

বিস্তার : ডাইনোসর জার্মানিতে প্রথম দেখা যায়। তবে বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন ডাইনোসর উত্তর আটলান্টিক বেসিনের কোথাও উৎপত্তি ঘটেছিল। যা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সাথে সংযুক্ত ছিল।

বর্তমানে এদের জীবাশ্ম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন ও আফ্রিকা থেকে পাওয়া গেছে। নিউজিল্যান্ড ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্র এদের পাওয়া যেত।