টার্গেট কিলিংয়ের শিকার ১৫ নেতা

রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিও বার্তা নিয়ে তোলপাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরে এখন ক্যাম্প কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান টার্গেট ক্যাম্পের মাঝি, নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা। ফলে ৪ মাসে ক্যাম্পে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৫ জন নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক।
সচেতন মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব না মানার প্রবণতা, অপরাধের প্রতিবন্ধকতা, ব্যক্তি স্বার্থ, আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব খুন হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের অধিকারের কথা বলতে না পারেন তার জন্য এসব টার্গেট খুন বলে মত রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞদের।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৫টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মাসে ১৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক।
উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আমর্ড পুলিশ ৩টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এসব এপিবিএন এর তথ্য মতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যায়। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।
৮ এপিবিএন এর উপ-অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানান, ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্যাম্প-১৮ এর একটি মাদ্রাসায় ৬ জনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে। এসব হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে সকলেই যখন উদ্বিগ্ন, তখন বিকল্প হিসেবে চালু হয় স্বেচ্ছায় পাহারার। ক্যাম্পটির প্রতিটি ব্লকে পাঁচজন করে রাতে স্বেচ্ছায় পাহারা দেওয়া শুরু করে। এরপর পর্যায়ক্রমে ৮ এপিবিএন এর আওতাধীন ১১টি ক্যাম্পের ৬৪টি ব্লকের ৭৭৩টি সাব-ব্লকে চালু হয় এ স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা। প্রতি রাতে ৩ হাজার ৮৬৫ জন রোহিঙ্গা পাহারা দিচ্ছে এ ১১টি ক্যাম্প। তারা কোন সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা, চিহ্নিত অপরাধী, মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের তথ্য দিচ্ছে এপিবিএন’কে।
তিনি জানান, স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়ার এই পদ্ধতির কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিবন্ধকতায় পড়েছে। যার জের ধরে এসব অপরাধিরা এখন স্বেচ্ছাসেবক এবং মাঝিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেছে। এতে স্বেচ্ছাসেবক ও মাঝিরাও হত্যার শিকার হচ্ছে।
এদিকে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চার মাঝিকে (নেতা) খুনের দায় স্বীকার করে এক রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিও বার্তা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও আকারে প্রকাশ হওয়া ভিডিওটি নজরে আসার পর সত্যতা যাচাইয়ে কাজ করছে বলে জানিয়ে ক্যাম্পে দায়িত্বরত এপিবিএন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা ভিডিওতে দেখা যায়, একটি অস্ত্র হাতে নিয়ে এক যুবক কিছু কথা বলছেন। যেখানে তিনি রোহিঙ্গাদের ভাষায় কথা বলেন। নিজেকে মোহাম্মদ হাসিম পরিচয় দিয়ে তিনি নিজের বাবার নাম বলেন আব্দুল জব্বার। বুচিথং এর কোয়ইংদং এর পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা এ যুবক ক্যাম্প ১৮ এ থাকেন এবং তাদের মাঝি নামও আব্দুল জব্বার বলে দাবি করেন।
এতে বলা হয়, ক্যাম্প ১৮ তে ২৫ জনকে ২৫টি পিস্তল দেয়া হয়েছে। হেড মাঝি সাহাব উদ্দিন, হেড মাঝি রহমত উল্লাহ, হেড মাঝি ভুঁইয়া, মৌলভি রফিক, কাদের, খাইরুল নামের এই ৬ ব্যক্তি এদের এসব অস্ত্র দেন। তাদের টাকাও দেয়া হয়। এরা ইসলামি মাহাস।
এ সব যুবকরা মিলে ক্যাম্পে হেড মাঝি আজিম উদ্দিন, হেড মাঝি ছানাউল্লাহ, হেড মাঝি জাফর, ক্যাম্প ১৭ এর ইসমাঈলকে খুন করেছে। তাদের দিয়ে এসব হত্যা করানো হয়েছে। এরপর ক্যাম্পে খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়ায় টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। টাকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা বুঝতে পেরেছে এটা অন্যায়।
যুবককে বলতে শোনা গেছে, ‘আমরা আমাদের ভাইদের হত্যা করে শেষ করে দিচ্ছি। এখানে আমাদের লাভ কি হলো। আমাদের ভাইদের আমরা শেষ করছি। পুরো কউম (জাতির) এর সামনে ভিডিও নিয়ে হাজির হয়েছি যে, আপনারা মা-বোনদের কাছ থেকে মাফ (ক্ষমা) চাই। হাজার হাজার মাফ (ক্ষমা) চাই। এরকম কাজ আর করব না, আপনাদের বলে রাখছি। এরকম খুন-খারাবি করেছি দেখলে, শরিয়ত মতে যে সাজা আসবে, কবুল করে নিব।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ভিডিওতে দেখেছেন এবং শুনেছেন। ওখানে এই যুবক যে পরিচয় দিয়েছে তা সত্য কিনা, এর পেছনে কোন রহস্য আছে কিনা, যাদের নাম উল্লেখ করেছেন তারা কারা? এসব তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় এটা বিভ্রান্তকর এবং রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য সবসময় সজাগ রয়েছি।’
উখিয়ার কুতুপালং এলাকার স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, সম্প্রতি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ক্যাম্প ভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।
কক্সবাজার পিপলস্ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল জানান, রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। কেউ নেতা হয়ে উঠবে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে তা না মানার প্রবণতা তাদের রয়েছে। এ সুযোগকে কাজ লাগিয়ে নেতৃত্বশূন্য করার কোন মিশন সশস্ত্র গোষ্ঠী বা ভিন্ন কোন মহল করছে কি না তা দেখা জরুরি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন অপরাধে ক্যাম্পের ঘটনায় যে সব মামলা হয় তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। প্রয়োজনে ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকেও সহায়তা দেয়া হচ্ছে।