টাকার বিনিময়ে কারাবরণ, আরেক অবিচার

আয়নাবাজি নামে বাংলাদেশের একটি সিনেমা দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সে সিনেমায় দেখা যায় মূল চরিত্র টাকার বিনিময়ে অন্যের হয়ে জেল খাটে এবং একসময়ে সে কারাপ্রহরীদের বোকা বানিয়ে জেল থেকে ভেগে যায়।
এটি সিনেমার কাহিনী হলেও বাস্তবে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে দেশের বিভিন্ন কারাগারে। বহু নিরপরাধ মানুষ শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে কারাবরণ করছে। তেমন একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।
সেখানে বলা হয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামির নাম নাছির আহমদ। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। আর টাকার বিনিময়ে নাছির সেজে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান চা-বিক্রেতা মজিবুর। তাঁর বাড়ি সাভারে। বিনিময়ে পান তিন হাজার টাকা। অবশ্য বেশি দিন কারাবাস করতে পারেননি মজিবুর। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের নেওয়া আঙুলের ছাপে ধরা পড়ে যান। ঘটনাটি গত ১৩ মার্চের।
শুধু মজিবুর নন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে এভাবে আত্মসমর্পণ করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আসা ১২ জনকে আঙুলের ছাপে শনাক্ত করা হয়। অন্য ১১ জন হলেন বাঁশখালীর মো. ইউসুফের পরিচয়ে শহিদুল ইসলাম, বগুড়ার নজরুল ইসলামের পরিচয়ে আরিফুল ইসলাম, পিরোজপুরের শফিকুল হাওলাদারের পরিচয়ে রফিকুল আহমেদ, রাঙামাটির মিনু মারমার পরিচয়ে পাইনদ্রু মারমা, কক্সবাজারের নাছিমা আক্তারের পরিচয়ে খতিজা বেগম, দিদারুল আলমের হয়ে কামাল হোসেন, মো. ছালামের পরিবর্তে চন্দনাইশের মো. আলম ও ছেনুয়ারা বেগমের বদলে টেকনাফের মনিরা বেগম, নগরের ইপিজেডের সেলিম উদ্দিনের পরিবর্তে বাঁশখালীর আবু নেছার, রাউজানের আবদুল করিমের পরিচয়ে আবদুল কাদের ও বাঁশখালীর মো. বাবুলের হয়ে সাইফ উদ্দিন। শেষ ১৩ অক্টোবর আঙুলের ছাপে ধরা পড়েন মাদকের মামলায় কক্সবাজারের ছেনুয়ারার হয়ে কারাগারে আসা মনিরা বেগম। ১২ জনের মধ্যে আলম ও মনিরা এখনো কারাবন্দি। বাকিরা জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
কারা সূত্র জানায়, তাঁরা সবাই ৩ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে স্বেচ্ছায় অন্যের হয়ে কারাগারে যান। মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচটি মাদকের, তিনটি ডাকাতির, দুটি চেক প্রত্যাখ্যানের, একটি অর্থঋণ আদালতের, আরেকটি সরকারি কর্মচারীকে মারধরের।
একটি চাঞ্চল্যকর মামলা ছিল, নগরের কোতোয়ালি থানার একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই কারাগারে যান মিনু আক্তার। মর্জিনা আক্তার নামের পূর্বপরিচিত এক নারী তাঁকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কারাগারে যেতে বলেন। তিনি কুলসুমাকে চেনেন না। তাঁর সন্তানদের দেখভালের জন্য মাসে মাসে টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু শেষের দিকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মিনু কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান।
২০২১ সালের ১৬ জুন তিন বছর পর মুক্তি পান মিনু। ওই সময় কারাগারে আঙুলের ছাপ চালু ছিল না। পরে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। গ্রেপ্তার হন কুলসুমা।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিমের মতে, আইনজীবী কোনো অবস্থায়ই দায় এড়াতে পারেন না। কারণ আইনজীবী নিজেই আত্মসমর্পণকারী আসামিকে শনাক্ত করেছেন।
কাজেই যাঁরা আইনের লোক, যাঁরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করেন তাঁদের আরও সতর্কতার সঙ্গে দেখভাল করা উচিত কারণ এর সঙ্গে জড়িত অসহায় ও ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জীবন। দেখতে হবে অপরাধী যেন পার পেতে না পারে এবং বিনা অপরাধে কেউ যেন শাস্তি ভোগ না করে। এ বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকেও সচেতন হতে হবে।