‘ঝরে পড়া মানুষের’ কবি

হুমাইরা তাজরিন »

‘সারাটি বৃত্তে ঘুরে ঘুরে খুঁজি, কোথায় আছিস অনন্তকাল -সেই কালপুরুষ।’ এভাবেই নিজেকে খুঁেজ বেড়াচ্ছেন একজন যাযাবর কবি। কখনও নওগাঁ, ঢাকা কখনও কখনওবা বরিশাল ঘুরে বেড়ান তিনি। কোনো নির্দিষ্ট পেশায়ও থিতু নন তিনি। শোনেন মানুষের গল্প। জীবনকে জানবেন বলে, গল্প লিখবেন বলে গল্প শুনতে, করেছেন ঢালাইয়ের মতো কাজ। যখন যেখানে জীবন যা-ই শেখায় তা-ই তিনি লুফে নিয়েছেন, করেছেন লেখনীর উপজীব্য।

কবি রশিদুল ইসলাম। যার বর্তমান পেশা রিকশা চালানো। এবারের অমর একুশে বইমেলায় চট্টগ্রামে বেরিয়েছে তার কবিতাগ্রন্থ ‘সেই কালপুরুষ’। বইটি উৎসর্গ করেছেন বাবা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন মন্ডল ও মা মোছাম্মৎ রহিমা বিবিকে। নন্দন বইঘরের প্রকাশনায় ও মঈন ফারুকের প্রচ্ছদে বইটিতে রয়েছে মোট ৪৮টি কবিতা। কবিতার বিষয়বস্তুতে উঠে এসেছে শ্রেণিচেতনা, ইতিহাসচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, মৃত্যুচেতনা, প্রেমচেতনা, প্রকৃতিপ্রীতি, মানবতা, ভক্তি, অতীতস্মৃতি, উত্তর-ঔপনিবেশিকতার মতো বিষয়গুলো।

‘সেই কালপুরুষ’ কবিতা গ্রন্থে ‘ঝরে পড়া মানুষ’ কবিতায় কবি রশিদুল লিখেছেন ‘হাজারো ¯্রােতের মধ্যে সামান্য অর্থের বিনিময়েÑ হাজার ঘণ্টা পরিশ্রম, তারপর তাকালাম, অসংখ্য মানুষ ঝরে যাচ্ছে।’

রশিদুল ইসলামের জন্ম ২৩ জুন ১৯৮৭ সালে নওগাঁ জেলার ধামাইর হাট থানার মহেশপুর গ্রামে। স্ত্রী মোবিনা আকতার। যিনি মহেশপুর গ্রামের বাড়িতে কৃষিকাজ ও ছোট্ট একটি খামার দেখাশোনা করেন। ফসল কাটার সময় রশিদুলও যোগ দেন স্ত্রীর সাথে। রশিদুল ইসলামের মেয়ে রাফিয়া জান্নাত এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছেলে মহসিন আলম পড়ছে প্রথম শ্রেণিতে। রশিদুল ইসলাম প্রতিদিনের রোজগার থেকে ৫০টাকা করে জমিয়ে রাখেন। সেই টাকা থেকেই তিনি এই দুর্মূল্যের দিনে নিজের র্দীঘদিনের শখ (বই প্রকাশ) পূরণ করেছেন, যেখানে তিনি তার মতো ‘অন্ধ কারাচ্ছন্ন কূপ’ থেকে উঠে আসা সকল মানুষের কথা বলেছেন। যাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন এই ‘কালপুরুষ’ রশিদুল ইসলাম নিজে।

আলাপচারিতায় রশিদুল ইসলাম জানান, ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ঝোঁক তার। গ্রামের মোহাম্মদ সোলাইমান আলী নামে এক চাচা প্রায় ম্যাগাজিন এনে দিতেন রশিদুলকে। সেই ম্যাগাজিনের পড়া গড়িয়েছে ম্যাক্সিম গোর্কি, ডেল কার্নেগীর প্রান্ত পর্যন্ত। কবিতায় এসেছে বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দের প্রভাবও। ব্যবহার করেছেন প্রচুর সংস্কৃত শব্দ। বাদ যায়নি নওগাঁর আঞ্চলিক শব্দগুলোও যেমন অবিয়ারি মাইয়্যা (অবিবাহিত মেয়ে), মিনমিনে (অল্পস্বল্প), দলিজা। কবিতা গ্রন্থ তিনি শুরু করেছেন মধ্যযুগের ধরায় ‘প্রার্থনা’ কবিতা দিয়ে। যেখানে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ দাতাদের প্রতি। শেষ করেছেন নাম শিরোনামের ‘সেই কালপুরুষ’ কবিতা দিয়ে।

রশিদুল ইসলাম জানান, এই বই প্রকাশের পিছনেও রয়েছে গল্প। নগরীর চেরাগীতে অবস্থিত নন্দন বইঘরে প্রায় বই পড়তে যেতেন। প্রতিমাসে কিনতেন বেশ কয়েকটি বই। নন্দন বইঘরের স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী জানান, ‘আমি কোনো রিকশাচালককে কখনও এভাবে বই পড়তে, কিনতে দেখিনি।’

এ ব্যাপারে সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘ একদিন আমরা শিল্পকলা একাডেমি থেকে মেলা শেষে বই নিয়ে চেরাগী ফিরতে রিকশা খুঁজছিলাম। কিন্তু প্রতিটা রিকশাই চড়া ভাড়া চাইছিলো। একজন রিকশা চালক দরদাম ছাড়াই আমাকে পৌঁছে দিতে চাইলো। আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। দীর্ঘদিন আমার বইঘরে তিনি পাঠক হিসেবে বই পড়েছেন, বই কিনেছেন। একদিন তিনি তার পান্ডুলিপি আমাকে দেয়। সেটা বোধ হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। আমার মনে হলো তার কথাগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরার মতো। এরকম বইপ্রেমী কবিতাপ্রেমী মানুষ এতো পরিশ্রম করেও পড়া-লেখার ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রেখেছে এটা আমার কাছে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক মনে হয়েছে।’

রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কবিতাগ্রন্থের প্রচ্ছদটি দেখুন। একটা গুহার মতোন দেখতে। যে স্যাঁতস্যাঁতে গুহার উপরে সবুজ শৈবাল জন্মেছে। যার একদম নিচতলায় এক আধটু সূর্যের আলো পৌঁছায়। এরকম অপেয় একটা জলের গুহাকার কূপের মধ্য থেকে উঠে এসেছি আমি; সংগ্রাম করে। আমি আমার উঠে আসার গল্পগুলোকেই কবিতার অনুষঙ্গ করেছি। আমার কোনো এক স্থানে থেমে থাকা ভালো লাগেনা। আমি এক কাজেও বেশিদিন থাকিনা। ভিন্ন ভিন্ন কাজ করি। এতে আমার নিত্য নতুন উপলব্ধি হয়। আমার স্ত্রী আমাকে অনেক সহযোগিতা করে। দাদা (সুব্রত কান্তি চৌধুরী) আমার বইয়ের সমস্ত কিছু তার নিজ তদারকিতে সম্পন্ন করেছেন। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’