ঝরেছে ৫০৩৭ শিক্ষার্থী, বাল্যবিয়ে ১৬৫৩

করোনায় ৩ পার্বত্য জেলা

সুপ্রভাত ডেস্ক »

করোনাভাইরাসের অভিঘাতে সারাবিশ্বের মতো ভুগছে বাংলাদেশও। দীর্ঘ সময়ের লকডাউনসহ অন্যান্য বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত অনেকেই কাজ হারিয়েছেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হারিয়েছেন পুঁজি। তাতে বেড়েছে দারিদ্র্য। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে কিশোরীদের ওপর। এই সময়ে সারাদেশেই বেড়েছে বাল্যবিয়ের প্রবণতা, সেইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার হারও বেড়েছে। দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় বিভিন্ন সূচকেই পিছিয়ে থাকা তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এই চিত্র আরও প্রকট হয়েছে। খবর সারাবাংলা।
এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনাকালীন তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলায় বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৬৫৩টি। অন্যদিকে দারিদ্র্যের কারণে এই সময়ে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়েছে ৫ হাজার ৩৭ শিক্ষার্থী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এই জরিপ চালিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। জরিপ কার্যক্রমে এলাকায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন তিন জেলার ৪ হাজার ৫৯২টি পাড়াকেন্দ্রে কর্মরত পাড়াকর্মী ও মাঠ সংগঠকরা।
বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একযোগে কাজ করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের মার্চে দেশে মরণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৭ মার্চ বন্ধ ঘোষণা করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এরপর ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। একই সময়ে আর্থিক সংকটেও ভুগেছে মানুষ। এ পরিস্থিতিতে অনেক পরিবারই সন্তানদের আর স্কুলে রাখা সম্ভব বলে মনে করেনি। অনেক পরিবার থেকেই কন্যাশিশুদের বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাল্যবিয়ের চিত্র
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের জরিপের তথ্য বলছে, গত এক বছরে তিন পার্বত্য জেলায় মোট ১ হাজার ৬৫৩টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলায় এই সংখ্যা ৬৮৪, বান্দরবানে ৫২৮ ও রাঙ্গামাটিতে ৪৪১। তবে বান্দরবানের ৫২৮টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে লামা উপজেলায়— ২০৩টি। পার্বত্য তিন জেলার ২৫ উপজেলার মধ্যে এই উপজেলাতেই বাল্যবিয়ের সংখ্যা সর্বোচ্চ।
প্রতিবেদনে উপজেলাভিত্তিক বাল্যবিয়ের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪৬টি, লক্ষ্মীছড়িতে ১৩৯টি, মানিকছড়িতে ১১০টি, রামগড়ে ১৩৬টি, দীঘিনালায় ১১৮টি, মহালছড়িতে ৫৫টি, পানছড়িতে ৩৮টি, গুইমারায় ১৪টি ও মাটিরাঙ্গায় ২৮টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলার সদর উপজেলায় দুইটি, কাপ্তাই উপজেলায় ৪১টি, কাউখালীতে ৭৯টি, রাজস্থলীতে ২৯টি, নানিয়ারচরে ১৪টি, লংগদুতে ১৩১টি, বাঘাইছড়িতে ৬৪টি, বরকলে ৩৭টি, জুরাছড়িতে ২৩টি ও বিলাইছড়িতে ২১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে একই সময়ে।
আর বান্দরবান জেলার উপজেলাগুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় ৯৫টি, রোয়াংছড়িতে ৪১টি, রুমায় ১৩টি, থানচিতে ৬৫টি, লামায় ২০৩টি, আলীকদমে ৫৩টি ও নাইক্ষ্যংছড়িতে বাল্যবিয়ে হয়েছে ১১১টি।
উপজেলাভিত্তিক এই তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে যে পাঁচ উপজেলায় হয়েছে সেগুলো হলো— লামা (২০৩টি), লক্ষ্মীছড়ি (১৩৯টি), রামগড় (১৩৬টি), লংগদু (১৩১টি) ও দীঘিনালা (১১৮টি)। অন্যদিকে কম বাল্যবিয়ে প্রবণ পাঁচ উপজেলা হলো— রাঙ্গামাটি সদর (দুইটি), রুমা (১৩৬টি), গুইমারা (১৪টি), নানিয়ারচর (১৪টি) এবং বিলাইছড়ি (২১টি)।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার চিত্র
জরিপে দারিদ্র্যের কারণে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার দিকটিও উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য বলছে, পার্বত্য তিন জেলার ৬৮ হাজার ৪৭৩ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ৫৬ হাজার ৪২ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসা করছে। কোভিড সংক্রমণকালীন দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়েছে ৫ হাজার ৩৭ কিশোর-কিশোরী।
পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে কিশোর-কিশোরীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে বান্দরবান। এই জেলার ২ হাজার ১২৮ কিশোর-কিশোরীকে স্কুল ছাড়তে হয়েছে। খাগড়াছড়িতে এই সংখ্যা ১ হাজার ৫৬১, রাঙ্গামাটিতে ১ হাজার ৩৪৮।
অন্যদিকে উপজেলাভিত্তিক তথ্য বলছে, দারিদ্র্যের কারণে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বাল্যবিয়েতে শীর্ষে থাকা লামা উপজেলাতেই। এই উপজেলার ৫৬৭ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে স্কুল থেকে। এই তালিকায় থাকা শীর্ষ বাকি উপজেলাগুলো হলো— নাইক্ষ্যংছড়ি (৪০৫ শিক্ষার্থী), বিলাইছড়ি (৩৫৫ শিক্ষার্থী), মানিকছড়ি (৩৪৫ শিক্ষার্থী) ও বান্দরবান সদর উপজেলা (৩১২ শিক্ষার্থী)।
কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
প্রকল্পটির তিন পার্বত্য জেলার প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর শুভাশীষ তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, জরিপের কাজে এক মাঠ পর্যায়ে গিয়ে অবস্থা পরিদর্শন করতে হয়েছে। সেখানে গিয়ে বাল্যবিয়ের অনেক প্রমাণ পেয়েছি। আবার খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুল্যাছড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিদর্শনের সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই জানিয়েছেন, তাদের বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ১২৭ জন শিক্ষার্থী ছিল। দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ের কারণে এর মধ্যে ২৩ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। জরিপের তথ্যের আলোকে আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজ করেছি।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় শিশু সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে উন্নয়ন বোর্ড। কর্মসূচির অংশ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সঙ্গে বৈঠক, জন্ম ও বিয়ে নিবন্ধকের জন্য ওরিয়েন্টশন কর্মশালা, ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সঙ্গে বৈঠক কর হচ্ছে। ক্লাস্টার পর্যায়ে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ বিষয়ক কমিউনিটি সংলাপ, জনবহুল স্থানে বাল্যবিয়ে নিরোধ বিষয়ক সচেতনতামূলক বার্তা সম্বলিত বিলবোর্ড স্থাপন, ইউনিয়ন পর্যায়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বাল্যবিয়ে নিরোধ বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন কর্মশালাও করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ এয়াছিনুল হক সারাবাংলাকে বলেন, প্রথম ধাপে খাগড়াছড়ি জেলার তিন উপজেলায় আমরা জরিপ করি। সেই জরিপে উঠে আসা তথ্য দেখে আমরা তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলাতেই জরিপের উদ্যোগ নিই। জরিপে তিন পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনাকালীন বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্যের কারণে কিশোর-কিশোরীদের ঝরে পড়ার চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। তাই বাল্যবিয়ে নিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাল্যবিয়ে নির্মূলে স্থানীয় হেডম্যান-কার্বারি (প্রথাগত প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি), ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের (ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্য) মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও ক্রীড়া সংগঠক নাছির উদ্দিন সোহেল।
তিনি বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সংরক্ষিত নারী মেম্বারদের বাল্যবিয়ে নির্মূলে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে হেডম্যান-কার্বারি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা পিছিয়ে থাকলে চলবে না। এ বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় নারী-শিশু অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নারীনেত্রী ও অধিকারকর্মী টুকু তালুকদার। পার্বত্য এলাকায় বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষা ও পারিবারিক ক্ষেত্রে ছেলে সন্তানের চেয়ে কন্যাসন্তানরা আগে থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। সমাজ ও পরিবারে মেয়ে সন্তানের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এখনো হয়নি। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি না হওয়ায় এখনো বাল্যবিয়ে ও দারিদ্র্যের কারণে সর্বপ্রথম কন্যাসন্তানরাই ঝরে পড়ছে।
তিনি বলেন, এ কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকাগুলোতে অনেক কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। এর জের ধরে বিবাহিত জীবনে পারিবারিক কলহ, সন্তান প্রসবে জটিলতা ও অন্যান্য দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
টুকু তালুকদার মনে করেন, শিশু অধিকার নিশ্চিতে ইউজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিয়ে নিরোধে যে কমিটিগুলো রয়েছে, সেগুলোর অস্তিত্ব কেবল কাগজে-কলমেই রয়েছে। নামসর্বস্ব এসব কমিটি খুব একটা কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। সামাজিকভাবে কন্যাসন্তানের প্রতি পরিবারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি ও শিশু অধিকার রক্ষায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।