জলাধার রক্ষা না করলে বিপর্যয় অনিবার্য

এই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের ১২ তলা ভবনের সপ্তম তলায় আগুন লাগে। ভয়াবহ সে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রধান অন্তরায় ছিল পানির অপ্রতুলতা। আশেপাশে কোনো জলাশয় ছিল না। সে সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ‘আগুন নেভানোর কাজে বেশি সময় লাগার কারণ পানির কোনও উৎস ছিল না। পাশে যে ভবনগুলো আছে সেখান থেকেও পানি নেওয়া যাচ্ছিলো না। আমরা যে পানি এনেছি সেগুলো দিয়ে কাজ চালিয়েছি। এরপর বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি নিয়েছি। রাস্তার পাশে যে ভবনগুলো আছে এগুলোর কাছাকাছি যেতে পারছিলাম না।’
এ বাস্তবতা শুধু রাজধানী ঢাকার নয়, চট্টগ্রামসহ বড় নগর সবগুলোর। চট্টগ্রাম নগরে সংঘটিত অগ্নিকা-ের সময়ও পানির উৎসের অভাবের কথা উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘গত ৩০ বছরে ১৮ হাজারের অধিক জলাশয় হারিয়ে গেছে। চট্টগ্রামে প্রতি বছর জলাশয়ের পরিমাণ ১০ শতাংশ হারে কমছে।’
১৯৯১ সালে জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপে চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ২৫০টি জলাশয় চিহ্নিত করা হয়। ২০০৬-২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জরিপে পাওয়া যায় ৪ হাজার ৫২৩টি জলাশয়ের সন্ধান। ২০১৬-২০১৭ সালে চবি ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাভূমির স্থানিক ও কালিক পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণায় চসিক এলাকায় ১ হাজার ৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করা হয়।
জানা যায়, চট্টগ্রামে মূল ও শাখা-প্রশাখা মিলে ১৮২.২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ১১৮টি খাল ছিলো। ২০১৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ৭৮টি খালের অস্তিত্ব পায়নি। ফলে মোট খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০টি। চসিক, চউক ও ওয়াসার হিসেবে নগরে ৩৬টি খাল থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালের জরিপে খালের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টিতে। আবার এসব খালের অধিকাংশ দখল হয়ে আছে।
জলাশয় সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুসারে, পুকুর-দীঘি ভরাট নিষিদ্ধ। ভূমির রেকর্ডে আরএস (রয়েল সার্ভে) ও বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে)-এ জলাশয় থাকলে তা কোনভাবেই ভরাট করা যাবে না। চউক’র ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ডিএপি) ১৫ কাঠা আয়তনের বড় জলাশয় ভরাট না করার নির্দেশনা রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ (সংশোধিত) অনুযায়ী যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, জলাশয় ভরাটের আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তি পত্র নেওয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ তা মানছে না। এভাবে জলাশয় ভরাট করে যেসব বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, সেগুলো ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
আসলে জলাশয় ভরাট না করার কথা কাগজে-কলমে যেভাবে আছে বাস্তবে সেরকম নেই। আমরা অপরিণামদর্শী জাতি হিসেবে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করছি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানই এই সর্বনাশা প্রবণতা রুখতে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এভাবে চললে বিপর্যয় আমাদের অনিবার্য।