চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব: হুয়াওয়ে মালিকের মেয়ের মুক্তি কি আপোষের ইঙ্গিত?

২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে এই বাড়িতে গৃহবন্দী ছিলেন হুয়াওয়ের মালিকের মেয়ে মাং ওয়ান জো

সুপ্রভাত ডেস্ক »

যুক্তরাষ্ট্রের দায়ের করা প্রতারণার অভিযোগ কাঁধে নিয়ে ১০০০ দিন কানাডায় গৃহবন্দী থাকার পর শনিবার যখন চীনা টেলিকম জায়ান্ট হুয়াওয়ের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মাং ওয়ান জো শেনজেন বিমানবন্দরে নামেন পুরো চীন আবেগের জোয়ারে ভাসছিল।

চীনা অনলাইন সার্চ ইঞ্জিন সিনা উইবোতে শনিবার দিনভর সবচেয়ে বেশি সার্চ হয়েছে মাংয়ের দেশে ফেরার প্রসঙ্গ। এ সম্পর্কিত বিভিন্ন ছবি- খবর-বিবৃতিতে কমপক্ষে ১০ কোটি হিট হয়েছে। চীনা সরকারী মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমস লিখেছে মাংকে বহনকারী বিমানটির অবতরণ থেকে শুরু করে বিমানবন্দরের টারমাকে তাকে সংবর্ধনার লাইভ স্ট্রিমিং দেখেছেন ৩ কোটি চীনা

২০১৮ সালের পহেলা ডিসেম্বরে মেক্সিকোতে একটি ব্যাবসায়িক সফরে যাওয়ার পথে ভ্যাঙ্কুভারে যাত্রাবিরতির জন্য নামার পর কানাডার পুলিশ মাং ওয়ান জোকে আটক করে। পরে জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রে সরকার ঐ গ্রেপ্তার চেয়েছে।

মিজ মাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়- যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে হুয়াওয়ে ইরানের সাথে ব্যবসা করেছে এবং তা চাপা দিতে এইচএসবিসি ব্যাংকের কাছে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কানাডার কাছে তার প্রত্যর্পণ চাইলেও আইনি লড়াই করে তা ঠেকিয়ে রাখে হুয়াওয়ে।

গত প্রায় তিন বছর মিজ মাং ভ্যাঙ্কুভারে তার কেনা বাড়িতে গৃহবন্দি ছিলেন। পুরো সময়টা তার গোড়ালিতে বাধা ছিল জিপিএস ট্র্যাকার যাতে ২৪ ঘণ্টা তার ওপর নজরদারী করা যায়।

এই গ্রেপ্তার নিয়ে কানাডার সাথে চীনের সম্পর্ক রাতারাতি তলানিতে ঠেকে। মিজ মাংয়ের গ্রেপ্তারের পরপরই চীনে ব্যবসার সূত্রে সফররত দুজন কানাডীয় নাগরিককে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক করা হয়।

তবে এই গ্রেপ্তার নিয়ে মূল কূটনৈতিক শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। প্রকাশ্যে এবং পর্দার আড়ালে।

অপমানিত চীন

প্রযুক্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের যে অসামান্য অগ্রগতি তার অন্যতম প্রতীক হুয়াওয়ে। এই কোম্পানি এখন বিশ্বের এক নম্বর টেলিকম যন্ত্র নির্মাতা।

কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা রেন জেংফেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য। একসময় চীনা সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিনি। তারই মেয়েকে – যাকে হুয়াওয়ের উত্তরসূরি হিসাবে দেখা হয় – এভাবে বিমানবন্দর থেকে আটক করে নিয়ে গিয়ে প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত করাকে চীন তাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতি আমেরিকার ইচ্ছাকৃত একটি আঘাত হিসাবে বিবেচনা করেছে।

“এমনিতেই আমেরিকানরা বলে যে চীনা সরকারের হয়ে হুয়াওয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছে। তারা এবং তাদের কটি মিত্র দেশ হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে শুরু করে। এর মধ্যে মাং ওয়ান জোকে যেভাবে আটক করা হয়, তাতে চীন চরম অপমানিত বোধ করেছে,“ বিবিসি বাংলাকে বলেন কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী।

এ কারণেই হয়ত শনিবার মিজ মাংয়ের দেশে ফেরার পর তাদের প্রথম পাতায় এক সম্পাদকীয়তে গ্লোবাল টাইমস লিখেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ওপর বেইজিংয়ের কূটনৈতিক চাপের পরিণতিতে “চীনের আত্ম-মর্যাদা বজায় রইলো।“

চীনা শর্তের তালিকায় মাং ওয়ান জো

কিন্তু চীনের কূটনৈতিক চাপেই কি আমেরিকা নতি স্বীকার করলো এবং মিজ মাং মুক্তি পেলেন?

আমেরিকান বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে রফা হয়েছে আদালতের মাধ্যমে আইনের আওতায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে চীনের পক্ষ থেকে আমেরিকা এবং ক্যানাডার ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করা হয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের মধ্যে একটি বৈঠকের প্রস্তাব নিয়ে কথা বলতে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েন্ডি শারমান চীনে গিয়েছিলেন।

উত্তরাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই‘র সাথে বৈঠক করেন তিনি। চীনা সরকারি সংবাদ সংস্থা শিনহুয়া এবং সেইসাথে একাধিক আমেরিকান মিডিয়ায় তখন খবর বের হয় যে চীনারা আমেরিকান মন্ত্রীর কাছে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন শর্ত সম্বলিত দুটো তালিকা ধরিয়ে দেয়। তার একটি তালিকার ছিল মাং ওয়ান জো‘র “নি:শর্ত মুক্তি।“

কানাডায় গৃহবন্দী হয়ে থাকার সময় মাং ওয়ান জোর পায়ে জিপিএস ট্র্যাকার

আমেরিকানরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও চাপ অব্যাহত রাখে চীন এবং তা নিয়ে কোনো রাখঢাকের চেষ্টা তারা করেনি।

নভেম্বরে গ্লাসগোতে আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনের আগে চীনের সাথে কিছু বোঝাপড়ার জন্য এ মাসের শুরুতে চীন গিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, যিনি বর্তমানে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূতের ভূমিকা পালন করছেন।

তিয়ানজিন শহরেই মিস্টার কেরির সাথে বৈঠক হয় জলবায়ু বিষয়ে চীনের প্রধান কর্মকর্তা শি জেনহুয়ার সাথে। এ নিয়ে লন্ডনের নির্ভরযোগ্য দৈনিক ফাইনানশিয়াল টাইমস তাদের দোসরা সেপ্টেম্বরের সংস্করণে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলছে তিয়ানজিনের বৈঠকে চীনের পক্ষ থেকে মি কেরিকে বলা হয় চীনের ব্যাপারে আমেরিকার “ভুল কৌশল“ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নষ্ট করছে এবং পরিণতিতে জলবায়ু নিয়ে দুই পক্ষের বোঝাপড়া “ঝুঁকিতে পড়েছে।“

তিয়ানজিনের বৈঠকের আগের দিন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক ভিডিও বৈঠকে জন কেরিকে খোলাখুলি বলেন “দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভালো না থাকলে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সহযোগিতা টেকানো কঠিন হবে।“

চীনা গবেষণা সংস্থা চায়না অ্যাকাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের গবেষক গাও লিওয়ান মনে করেন চীনের চাপের মুখেই যুক্তরাষ্ট্র মিজ মাংয়ের মুক্তি ব্যাপারে আপোষ করেছে। তাকে উদ্ধৃত করে গ্লোবাল টাইমস লিখেছে “(যুক্তরাষ্ট্রের) হাতে কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড প্যানডেমিকের মত লড়াই মোকাবেলায় চীনের সহযোগিতার কোনো বিকল্প তাদের নেই। চীনের সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জেরে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি এবং সরকারি ঋণ বেড়েই চলছে।“

গোপন বোঝাপড়া?

ড. মাহমুদ আলীও মনে করেন হুয়াওয়ে কর্মকর্তার মুক্তির পেছনে একটি “রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত“ কাজ করেছে। “আড়াই বছর ধরে এই টানাপড়েন চলছিল। অপরাধের অভিযোগ তো বদলে যায়নি। তাহলে হঠাৎ এই মুক্তি কেন? তাছাড়া মাংয়ের মুক্তির সাথে সাথে চীন দুই কানাডীয়কে মুক্তি দিয়ে দিল। মীমাংসার ইঙ্গিত স্পষ্ট।“

আপোষের আরো ইঙ্গিত রয়েছে। হুয়াওয়ের মালিকের মেয়েকে মুক্তির সিদ্ধান্ত যেদিন হলো, সেদিনই অর্থাৎ শুক্রবার আমেরিকার বাণিজ্য মন্ত্রী জিনা রাইমোন্ডোকে উদ্ধৃত করে দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায় যে তিনি চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবেন এবং বেশ কজন কোম্পানি নির্বাহীকে সাথে নিয়ে তিনি চীনে যাবেন, যদিও দিনক্ষণ উল্লেখ করেননি মন্ত্রী।

গ্লোবাল টাইমস শনিবার তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “তিন বছর আগে যে বিশৃঙ্খলার জন্ম হয় মাংয়ের মুক্তি তা ঘোচাতে সাহায্য করবে বলে আমরা আশা করি। “ কিন্তু একটি কোম্পানির একজন কর্মকর্তার মুক্তিতেই কি চীন-মার্কিন সম্পর্কে বরফ গলা শুরু হবে?

ড মাহমুদ আলী বলেন অদূর ভবিষ্যতে সম্পর্কে মৌলিক কোনো বদল হবে বলে তিনি মনে করেন না।

”ট্রাম্প চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে নীতি নিয়েছিলেন বাইডেনও তা গ্রহণ করেছেন এবং তাতে তিনি অনড়। তিনি বরঞ্চ ত্রিদেশীয় অকাস (যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-অস্ট্রেলিয়া) প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছেন। কোয়াড জোটকে শক্তিশালী করছেন। এগুলো সম্পর্কে উত্তেজনার প্রধান সব উৎস,“ বলেন ড. আলী।

তবে মি. বাইডেন প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তন এবং পারমানবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মত বৈশ্বিক ইস্যুতে তিনি চীনের সাথে সহযোগিতা চান। তিনি বলেছেন চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কূটনীতিই হবে তার প্রথম অগ্রাধিকার। বৃহত্তর কিছু স্বার্থে আপোষে যে তিনি প্রস্তুত সে ইঙ্গিত মি. বাইডেন দিচ্ছেন।

তবে, ড আলী বলছেন, মাং ওয়ান জো‘র মুক্তিতে চীনের ক্রোধ কতটা প্রশমিত হয়েছে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে আসন্ন দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে – প্রথমে অক্টোবরের শেষে রোমে জি-২০ জোটের শীর্ষ বৈঠকে এবং পরপরই নভেম্বরে গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনে।

“জি-২০ সম্মেলনে শি জিন পিং এবং জো বাইডেনের কোনো মুখোমুখি বৈঠক হয় কিনা এবং জলবায়ু সম্মেলনে মি. শি বা চীনা প্রধানমন্ত্রী হাজির থাকবেন কিনা তা থেকে বোঝা যাবে সম্পর্কে বরফ সত্যিই গলছে কি গলছে না,“ বলেন ড. আলী।

তবে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটো করাই যে এখন যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য তা নিয়ে রাখ-ঢাক করছে না বাইডেন প্রশাসন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আমেরিকা এখন থেকে তাদের বাৎসরিক ৭০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা বাজেটের ৬০ শতাংশই খরচ করবে এশিয়া প্রশান্ত-মহাসাগরীয় এলাকায় অর্থাৎ চীনের আশপাশে।

ফলে, ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে চীন-মার্কিন ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে বাস্তবতা তাতে মৌলিক কোনো বদলের সম্ভাবনা সহসা নেই বললেই চলে। ।

সূত্র : বিবিসি