চলে গেলেন প্রকৌশলী আলী আশরাফ

নিজস্ব প্রতিবেদক :
না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ। পেশাদার একজন নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী এবং শিক্ষাবিদকে হারালো চট্টগ্রাম। নগরের পাহাড় কাটা, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ে মিডিয়ায় এবং গবেষণায় সক্রিয় ছিলেন আলী আশরাফ। ৬৮ বছর বয়সে তিনি গত শনিবার দিবাগত রাত দুইটায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন।)
কর্ণফুলী নদীর উপর যখন ঝুলন্ত ব্রিজ নিয়ে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আন্দোলন করছিলেন, তখন তা সরকারের পক্ষ থেকে মানা হচ্ছিল না। একইসময় পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের ব্যানারে ক্যাবল স্ট্রেইড ব্রিজের স্লোগান তুলেন আলী আশরাফ। পরবর্তীতে সেটিও মানা হয়নি। পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ হলেও পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন আলী আশরাফ। বিশ্বের সব স্থানে পাহাড়ে স্থাপনা রয়েছে, তাই চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কেন অব্যবহৃত থাকবে? ব্রিটিশরা পাহাড়ের উপরে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বলে এখনো সেসব পাহাড় অক্ষত রয়েছে, বাকি পাহাড়গুলো বিনাশ হয়েছে। সিডিএ’র নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য হওয়ায় এবং মিডিয়ায় কথা বলায় সোচ্চার থাকায় পরবর্তীতে পাহাড়ে স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদন দেয় সিডিএ। ফলে বর্তমানে বিভিন্ন পাহাড়ে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন দুটি খাল খননের কথা বলে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। তার জোরালো বক্তব্যের কারণে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়লাভ করা এম মনজুর আলম বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া খাল খননের প্রকল্প গ্রহণ করেন। যদিও এই খাল খননের কাজ বাস্তবিক অর্থে এখনও শুরু হয়নি। তেমনিভাবে নগরের পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন।
গতকাল দুপুর দেড়টায় তাঁর প্রথম জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি ছিল। চট্টগ্রামের পরিকল্পিত উন্নয়নে আলী আশরাফের অবদান অনেক বেশি ছিল বলে মন্তব্য করেন এপিক প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন,‘ আশরাফ ভাই চলে যাওয়া মানে চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনায় বিশাল এক শূন্যতা।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোখতার আলম সোস্যাল মিডিয়া ফেইসবুকে মন্তব্য করেছেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা, একটি আধুনিক নগর গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা বিদায় নিল। এতে চট্টগ্রামের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।’ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউশন অব বাংলাদেশ (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রবীর কুমার সেন লিখেছেন, শোকাহত, শোকাহত, শোকাহত। আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের জন্য অফুরান ক্ষতি। একইভাবে সোস্যাল মিডিয়ায় অনেকেই এ পরিকল্পনাবিদের অকালে চলে যাওয়াকে চট্টগ্রামের জন্য বিশাল ক্ষতি হিসেবে দেখছেন।
ফটিকছড়ির জাহানপুরের মরহুম অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নুরুল হুদার বড় ছেলে এম আলী আশরাফ। তিনি ১৯৭৬ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বিআইটি) বর্তমানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর এবং অঞ্চল পরিকল্পনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অধীনে ১৯৯৫ সালের মাস্টারপ্ল্যানের প্রণীত কমিটির সদস্য, সিডিএ’র নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এই হাসপাতালের উদ্যোগে নির্মিত হতে যাওয়া ক্যান্সার হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক, নগরের নদী খাল রক্ষা কমিটির আহ্বায়কসহ বিভিন্ন কমিটিতে জড়িত ছিলেন গুনী এ ব্যক্তি।
গতকাল বাদ জোহর জমিয়তুল ফালাহ জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ির জাহানপুরে। পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
উল্লেখ্য, প্রকৌশলী আলী আশরাফ কিছুদিন আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে লাইফ সাপোর্ট থেকে আইসিইউ কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। একইসময়ে তিনি কোভিড পরীক্ষায় নেগেটিভ হন। গত শনিবার তিনি বিছানা থেকে নিজে নিজে উঠে বসতেও পেরেছিলেন এবং খাবারও খেয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু দিবাগত রাত দুইটায় তিনি মারা যান।