চট্টগ্রামে গরুর ব্যবসার বিকাশ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ সালের দিকে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের সন্তানদের শখের বসে খামার করার মধ্য দিয়ে। সেসময় দুধ ও মাংসের জন্য গবাদিপশুর খামার গড়ে তোলাকে খুব বড় কোনো বিজনেস মডেল হিসেবে দেখা হতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেককিছুই বদলে গিয়েছে, গত আট বছরে প্রচুর কর্পোরেট পুরুষেরা এই ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন এবং হাজার হাজার গরু লালন পালন করছেন; বিশেষ করে ঈদুল আজহা থাকে তাদের প্রধান লক্ষ্য।

এই যেমন, এশিয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি এম এ ছালামের সন্তান ওয়াসিফ আহমেদের কথাই ধরা যাক। ২০১৬ সালে স্রেফ শখের বসে চারটি গরু দিয়ে শুরু করেন খামার। সেসময় ১৯ বছর বয়সী ওয়াসিফের শুরু করা এশিয়ান অ্যাগ্রো’তে চলতি বছরে প্রস্তুত করা হয়েছে ১২০টি কোরবানিযোগ্য পশু।

শুধু ওয়াসিফ নন, বিত্তশালী পরিবারের বহু তরুণ এখন গবাদিপশুর খামারের ব্যবসা নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের সন্তান ও তরুণ উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন ৬০টির বেশি অ্যাগ্রো ফার্ম। প্রবাসী ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর চাহিদা মাথায় রেখে এসব খামারে গরু মোটাতাজা করা হয়। এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রস্তুত করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ‘হেভিওয়েট’ গরু। আড়াই লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা দামের গরুও মিলছে কর্পোরেট এই খামারগুলোতে। খবর বিটিএস’র। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের তরুণ পরিচালক হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা মার্শাল এক সময় শখের বসে গড়ে তুলেছিলেন টিকে এগ্রো। খামারটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে কোরবানিযোগ্য পশুর তৈরির নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে। চলতি বছর এই খামারে মোটাতাজা করা হয়েছে শাহিওয়াল, ফ্রিজিয়ান ও ক্রস ফ্রিজিয়ান জাতের ২০০টি গরু।

হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা মার্শাল বলেন, ‘আমাদের খামারের গরুগুলোকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক খাবারে লালন-পালন করা হয়। ক্রেতারা নিজেরা এসেই দেখতে পান, গরুকে কি ধরনের খাবার দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত দাম রাখা হয়না। তাই আমাদের খামারের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা তৈরি হয়েছে। যারা একবার আমাদের থেকে কোরবানির জন্য পশু কেনেন, তারা প্রতিবছরই গরুর জন্য আমাদের কাছে আসেন।’ তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমাদের খামারে সর্বোচ্চ সাড়ে আট লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। খামার থেকেই আমরা কোরবানি জন্য পশু বিক্রি করে থাকি, কখনো বাজারে নিয়ে যাওয়া লাগেনা। ইতোমধ্যে খামারের ৩০ শতাংশ পশু বিক্রি হয়ে গেছে।’

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি ও আরডিএম গ্রুপের চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরীর করোনা মহামারিতে পোশাক কারখানার পাশেই ৩০ কাঠা জায়গা নিয়ে গড়ে তোলেন গরুর খামার ‘ইউনি এগ্রো ফার্ম’। চলতি বছর খামারে ১০০টি ‘হেভিওয়েট’ গরু প্রস্তুত করেছেন তিনি।

রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমার খামারে সর্বনি¤œ আড়াই লাখ টাকা থেকে ১২ লাখ টাকা দামের গরু আছে। মূলত ব্যবসায়ি বন্ধু ও পরিচিতজনরাই আমাদের গ্রাহক। তাদের চাহিদা মাথায় রেখেই আমরা গরু গুলো প্রস্তুত করেছি। ইতোমধ্যেই ৪০ শতাংশ গরু বিক্রি হয়ে গেছে।’

চট্টগ্রামের আরেকটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ওয়েল গ্রুপের খামার ‘ওয়েল এগ্রো’। ওয়েল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের খামারে বর্তমানে ২৫০টি গরু রয়েছে, যেখান থেকে প্রতিদিন ১ টন দুধ উৎপাদন হয়। এর পাশাপাশি খামার থেকে কোরবানির জন্যও গরু বিক্রি হচ্ছে।’

নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রামের অন্যতম আমদানি-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিলো ওয়ার্ল্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন। প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধিকারী আবুল কালামের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান তানভির কামাল কর্ণফূলীর দক্ষিণ তীরে এক একর জমিতে গড়ে তোলেন ‘ওজি এগ্রো’। চলতি বছর প্রতিষ্ঠানটি কোরবানির জন্য ৫০টি গরু মোটাতাজা করেছে এবং ইতোমধ্যে ৩৭টি গরু বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান তানভির কামাল।

বিক্রি বেড়েছে খামারে
জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবার চট্টগ্রামে ছোট বড় ৩০০০ খামারে প্রস্তুত করা হয়েছে ৫০ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু। কোনো কোনো খামারে এরই মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পশু বিক্রি হয়ে গেছে।

ক্রেতা–বিক্রেতা দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগেভাগে বেচাকেনা হওয়া গরুগুলো ঈদ পর্যন্ত খামারেই থাকবে। ক্রেতার চাহিদার ভিত্তিতে ঈদের আগে কোরবানির পশু নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খামারেই পশু কোরবানি করে ক্রেতার কাছে মাংস পাঠানো হবে। উভয় ক্ষেত্রেই ক্রেতাকে আলাদা খরচ বহন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কোরবানির ঝক্কি অনেক কম হয় বলে জানান ক্রেতাদের কেউ কেউ।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর বলেন, ‘গত মঙ্গলবার (২০ জুন) থেকে চট্টগ্রাম নগর ও ১৫টি উপজেলায় পশুর হাট বসলেও খামারে পশু বিক্রি শুরু হয়েছে চলতি মাসের শুরুতে। প্রতিবছর কোরবানির শেষ মুহুর্তে এসে পশু সংকট দেখা দেয়, দামও বেড়ে যায় অনেক। তাই এই অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে শহরের বাসিন্দারা আগেভাগেই কোরবানির পশু কিনে ফেলছেন। পশু কিনে কোরবানির আগ পর্যন্ত তা খামারেই রেখে দিচ্ছেন।’

হাটহাজারী এলাকার খামারি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে কোরবানির পশু বিক্রি করে আসছি। সে সময় খামারের গরু হাটে নিয়ে বিক্রি করতে হতো। কিন্তু করোনার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন পশু বিক্রির জন্য এখন আমাদের আর হাটে যেতে হয়না, বরং খামার থেকেই শতভাগ গরু বিক্রি হচ্ছে। এ বছর ৭৮টি গরু মোটাতাজা করেছিলাম, ইতোমধ্যে ৩৭টি বিক্রি হয়ে গেছে।’ গত মঙ্গলবার ছিল চট্টগ্রামে পশুর হাটের প্রথম দিন। বুধবারও ট্রাকে ট্রাকে গরু এসেছে চট্টগ্রামের হাটগুলোতে। তবে হাটে পর্যাপ্ত কোরবানির পশু থাকলেও ক্রেতার উপস্থিতি এবং বিক্রি ছিল কম।

ইজারাদাররা জানিয়েছেন, শহরের কোরবানিদাতাদের বেশিরভাগই রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যার কারণে শেষ দিকেই কোরবানির পশু কেনেন। তাই ওই হিসেবে বাজার জমে উঠতে কয়েকদিন সময় লাগবে।