‘ঘরে নয় মরলে এই হাসপাতালেই মরবো’

ডায়ালাইসিসের মূল্যবৃদ্ধি, চমেকে বিক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক »
দশ বছর ধরে কিডনি রোগে আক্রান্ত মোহাম্মদ আকবর আলী (৫৫)। ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা নিচ্ছেন। প্রতিবারের মতো গতকাল সকালে হাটহাজারী থেকে রওনা হন। হাসপাতালে পৌঁছালে ডায়ালাইসিস নিতে গেলে ৫৩৫ টাকা জমা দিলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে বলা হয় ২ হাজার ৯৩৫ টাকা না দিলে ডায়ালাইসিস করানো হবে না। এরপরই রাস্তায় শুয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তিনি।

বিক্ষোভরত অবস্থায় রাস্তায় শুয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিমাসে আমাকে ৮ বার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। ২ হাজার ৯৩৫ টাকা দিয়ে আমার পক্ষে ডায়ালাইসিস করানো সম্ভব না। আমি কর্মহীন মানুষ। ডায়ালাইসিস করাতে না পারলে মরে যাব। ঘরে নয়, মরলে এই হাসপাতালেই মরবো।’
চমেক সূত্রে জানা যায়, একজন রোগীকে মাসে ৮ বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। তার জন্য আগে থেকে মাসের প্রথম দুবার ২ হাজার ৭৯৫ টাকা করে পরিশোধ করতে হতো। পরের ছয় বারে ৫১০ টাকা করে পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে থেকে ২ হাজার ৭৯৫ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা করা হয়। প্রথম দুই বারের পরিবর্তে এখন চারবার ওই ফি পরিশোধ করতে হবে। আবার অবশিষ্ট চারবার ৫১০ টাকার বদলে ৫৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি রোগীকে ডায়ালাইসিস ফি বাবদ মাসে প্রায় দ্বিগুণ খরচ বহন করতে হবে। এর আগে প্রতি মাসে ৮ হাজার ৬৫০ টাকা খরচ হতো। বর্তমানে পরিশোধ করতে হবে ১৩ হাজার ৮৮০ টাকা।

মোহাম্মদ আকবর আলীর মতো আরো দেড়শ লোক গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। এ সময় তাদের সাথে বিক্ষোভে অংশ নেন রোগীর স্বজনরাও। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ভিড় জমিয়েছেন তারা। গতকাল ৫৩৫ টাকা দিয়ে যাদের ডায়ালাইসিস করার কথা ছিলো তাদের কাউকেই ডায়ালাইসিস করানো হয়নি। কোনো রোগীই চারবার ২ হাজার ৭৯৫ টাকা দিতে রাজি নয়।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ঢাকায় ৫৩৫ টাকা দিয়ে ডায়ালাইসিস করানো যায়। চট্টগ্রামের মানুষ কেন এত টাকা দেবে। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে এত টাকা কিভাবে মানুষ পরিশোধ করবে। একটা ডায়ালাইসিস ৬ বার ব্যবহার করা হয় এখানে। ঢাকায় ৮০০ টাকার মতো খরচ করে একটা ডাইলিসিস পাওয়া যায়। সেটা পরে আর ব্যবহার করা হয় না। তারা আরও বলেন, বার বার বলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি ভারতের। চমেকের কি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমাদের কোনো গতি না করলে আমরা হাসপাতাল প্রাঙ্গণ ছাড়বো না।
এদিকে বিক্ষোভকারীরা সকাল ১১টার দিকে স্যান্ডরের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ফলে কেউ চিকিৎসা সেবা নিতে পারেনি। এ সময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন স্যান্ডরের কর্মীরা।

পরে বিকাল চারটার দিকে স্যান্ডরের কার্যালয় খোলার পর সেখানে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তিন জন প্রবেশ করে। সেখানে তারা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে চমেক পরিচালকের কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে ফিরে সুজন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘ডায়ালাইসিসের দাম কমানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা ফলপ্রসু হয়নি। তবে স্যান্ডর থেকে বলা হচ্ছে তাদের যা ফান্ড রয়েছে সেটা দিয়ে গতকাল (৮ জানুয়ারি) এবং আজকে (৯ জানুয়ারি) চিকিৎসা চালিয়ে যাবে। এরপর থেকে ফের ২ হাজার ৭৯৫ টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন রোববার তো বিক্ষোভ করে করে সারাদিন চলে গেলো। সেই দিন ধরবো কেনো। ৫০-৬০ জনের অধিক রোগী ডায়ালাইসিসের জন্য অপেক্ষায় আছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি এর কোনো সুরাহা হয় কিনা। কিন্ত কোনো মহল থেকে সিদ্ধান্ত এলো না। আমরাও মাঠ ছাড়বো না।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান এর সাথে। তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে স্যান্ডর কর্তপক্ষের চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ফি বাড়ে। এ বছরও বেড়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং দরিদ্র রোগীদের বছরজুড়ে সাড়ে ছয়শ’ সেশন ফ্রি সেবা দিয়ে থাকি। কিন্তু বছর বছর আমাদের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অথচ সেশন বাড়ছে না। এখন রোগী কতটা সেশন কোন সুবিধায় পাবেন তার শিডিউল জানতে এসে তারা ফি বাড়ানোর বিষয়টি জানে। আবার বেশি রোগী হওয়ায় অনেককে সেবা দিতে না পারায় তারা কিছু দাবি জানিয়েছে। বিষয়টা হলো এটা ভারতের একটি প্রাইভেট কোম্পানি। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তারা নেবেন।’

বিক্ষোভের কারণে অন্য চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চরম ভোগান্তি পেতে হয়েছে। এর শেষ কোথায় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। নিজস্ব ডায়ালাইসিস মেশিন বসানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। যাতে গরীব রোগীদের সাহায্য করতে পারি’।