কৃষ্ণচূড়া ঝরার দিন

আরিফুল হাসান

তখন বৈশাখের শেষ প্রায়। আমাদের গ্রামের পথে সিএসজিটা এঁকেবেঁকে চলে। ভাঙা রাস্তায়, টিলা-টক্করে ঠক্কর খেতে খেতে এগিয়ে চলে। দূর থেকে দেখা যায় গ্রামের কবরস্থানে ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটি। গাছটি ছামাদ মিয়ার কবরের কাছে। ছামাদ মিয়ার মৃত্যুরও আগে থেকে মাথা তুলে আছে। ছামাদ মিয়ার মৃত্যুও হয়েছে এই কৃষ্ণচূড়া গাছেই ফাঁসি দিয়ে। তখন মন্বন্তর। মানুষের ঘরে ভাত নেই। বনের কচুঘেচু খেয়ে মানবেতর বেঁচে থাকা। টানা দুই বছর অনাবৃষ্টিতে ফসল না হওয়া আর তৃতীয় বছর প্রবল বন্যায় ভাসিয়ে নেওয়া এই অভাবের কারণ।

ছামাদ মিয়ার ঘরেও ভাত নেই। সোমত্ত মেয়ে পেট বাঁচাতে দিনে-রাতে দু’বার গিয়ে জহির  মোড়লের সাথে শোয়। বিনিময়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটে তার। কিন্তু ছামাদ মিয়া এই দানা মুখে তুলবে না। সে সোমত্ত মেয়েকে ঠেঙায়। অনাহারের শরীরে মেয়ের সাথে পেরে ওঠে না। মেয়ে গরুর পা জুন দিয়ে ছামাদ মিয়ার মাথায় মারে। ফেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরোয় নিংড়ে। ছামাদ মিয়া গ্রামের আর পাঁচজনের কাছে বিচার চায়। কিন্তু বিচার করবেটা কে? অভাবের সময়, লোকে পেট বাঁচাতে যে যেটা পারে করছে। কেউ নিজের মাগকেও দিয়ে দিচ্ছে পরপুরুষের হাতে সামান্য দুটো ভাতের জন্য। তবু ভাত জোটে না। পেট বাঁচলে তো চেটের চিন্তা। একটানা তিন বছর শস্যহীন থাকায় অবস্থাপন্ন ঘরগুলোও দরিদ্রের নিচে নেমে এসেছে। পরহেজগার ঘরগুলোতেও তৈরি হয়েছে চোর। আর চুরি করবেটা কি? কালিগঞ্জ বাজারে যার যেটা অস্থাবর সম্পত্তি ছিল সব বেচে দিয়েছে। ঘরে আর এমনকি মালশাটাও নেই যে বেঁচে একমুঠো চাল কিংবা পোয়টেক চাল কিনে আনে। তাই তারা বন্যার পানিতে কচুরিপানার গোড়া সিদ্ধ করে খায়। বিল থেকে ভেটফল এনে ভাত রান্নার বৃথা চেষ্টা করে। ভেটের ভাত খেয়ে কতজনের কলেরা হয়। ওলাওঠায় মারা যায় অসংখ্য মানুষ। বন্যায় চারপাশ ডুবে গেলে তাদেরকে আর কবর দেবারও জায়গা থাকে না। তখন কলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দেয়া হয় লাশ। অন্য গাঁও থেকে অন্য অনেকের লাশও এসে লাগে এই গ্রামের ঘাটে। গ্রামের পোলা-ছোকড়ারা বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে সেসব অর্ধপচা লাশ আবার স্রোতের গতিতে ফিরিয়ে দেয়। লাশ ভেসে চলে। ভেসে চলে মানুষের জীবন। মন্বন্তরের ভেতর মানুষের জীবনগুলো জীর্ণ হতে-হতে আপনি এসে নিবে যায়।

এই দুই-তিন বছরে অনেক লোকের মৃত্যু হয়েছে গ্রাম থেকে। তবু মানুষ আশায় বেঁচে আছে। এ বছর যে বন্যা হলো, আগামী বছর নিশ্চয়ই মাঠে-মাঠে সোনাধান ফলবে। আবার ভরে উঠবে কৃষকের গোলা। আবার ভাতের গন্ধে মানুষের মনে স্বর্গীয় সুখ নেমে আসবে। পুকুরে-ডোবায় পড়বে হরেক প্রজাতির মাছ। মাছে-ভাতে বাঙালির চিরায়ত ঐশ্বর্য আবার হাসবে। কিন্তু সে দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে পারে নাছামাদ মিয়া। বৌ মরেছে গত বছর না খেতে পেয়ে। একটি কোলের ছেলে ছিল, কচুসেদ্ধ খেয়ে গলা ফুলে মরে গেছে। শুধু পাথরের মতো টিকে আছে সে আর তার সোমত্ত মেয়ে। মেয়েটি পেট বাঁচাতে দেহ বেচে। তাও যদি বেচতো তবু একটি কথা ছিল। বলা যায় দেহ দেয়। এই দুই বছরের ভেতর সে তিনবার পেট খসিয়েছে। জহির মোড়ল বাঁশের কঞ্চি দিয়ে একবার নিজেই পেট খসিয়ে দিয়েছে। অবশিষ্ট রক্তটুকু ঝরে পড়লে মেয়েটি বেমক্কা পানিতে ভার হয়ে ওঠে। তার শরীর ফুলে এমনই অবস্থা হয় যে বাঁচবে বলে আর কেউ মনে করে না। তবু মেয়েটি বেঁচে ওঠে এবং বেঁচে ওঠে আবার যায় জহির মোড়লের কাছে। পেটের বাঁচা বড় বাঁচা, যার জন্য মৃত্যুপথযাত্রীও পেটের চিন্তা করে। প্রথম-প্রথম জহির মোড়ল আগের মতো মজা পায়না। মেয়েটিকে দুই বেলা ভাতের পরিবর্তে এক বেলা দেয়। তাই খেয়েই মেয়েটি দিনের পর দিন যায় মোড়লের কাছে। ছামাদ মিয়া কিছু বললে পাজুন হাতে তেড়ে আসে তাকে মারতে। শীর্ণ মড়মড়ে দেহ নিয়ে ছামাদ মিয়া কিছু করতে পারে না। রাগে তার কুচকে যাওয়া চামড়ার আঙুল থরথর করে কাঁপে। উঠানে দাঁড়িয়ে মেয়েকে শাপ-শাপান্ত করে। কিন্তু মেয়ে তার কথা শুনবে কেন? একদিন তো মেয়ে বলেই ফেলেছে, ভাত দে, তইলে তরেও দেহ দিয়াম। শুনে ছামাদ মিয়ার মরে যাবার মতো অবস্থা। খানকিটা বলে কী? আবার ভাবে, কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে ভাবে, ঠিকই তো, পেটের কাছে সবকিছুই তুচ্ছ। তবু মেয়ের এই অগস্ত্য যাত্রা মেনে নিতে পারে নাছামাদ মিয়া। রাতের অন্ধকারে মেয়েকে জবাই করার জন্য বটি হাতে মেয়ের শিয়রে যায়। মেয়ে  জেগে ওঠে। কোনো রকম শোরগোল না করে বাবার হাত থেকে বটিটা নিয়ে বাইরের পুকুরে ছুড়ে মারে। তারপর যেমন ছিল তেমন এসে শুয়ে পড়ে। ছামাদ মিয়া নিজের বিছানায় ফিরে গোঙায়, রাগে অথবা অভিমানে-অপমানে।

বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে নৌকা বা ভেলার দরকার হয়। ছামাদ মিয়া নৌকা পাবে কোথায়? ছিল  হালের গরু, ঘাটের নৌকা ঘরভরা সুখ, সবই ছিল। টানা দুই বছরের অনাবৃষ্টি তার সব কেড়ে নিয়েছে। এমনকি ভেলা বানানোর জন্য একটি কলাগাছও নেই বাড়িতে। সোমত্ত মেয়েটি গলাসমান জল সাঁতরে দুদিন গিয়েছে জহির মোড়লের বাড়িতে। আজ ক’দিন হয় জ্বরে বেঘোর পড়ে আছে মাচার ওপর। রাতের কালো শব্দ ভেদ করে ছামাদ মিয়া বৈঠার ছলাৎছলাৎ শব্দ শোনে। জহির মোড়লের নৌকো এসেভিড়ে ছোট্ট মাচাটির কাছে। লাফিয়ে মাচার ওপর উঠলে বাঁশের মাচা কঁককঁক করে কঁকিয়ে ডানে-বাঁয়ে দুলে উঠে। সেই দুলুনির ভেতর জহির হামলে পড়ে ঘোরগ্রস্ত মেয়েটির ওপর। হয়তো জহির মোড়লের মুখে ভাতের, সালুনের গন্ধ পায়  মেয়েটি, সেই গন্ধে জেগে ওঠে। ছামাদ মিয়া মাচার একপাশে রাতের কালোর ভেতর মিশে যেতে থাকে। পরদিন থেকে আর ছামাদ মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় যে গিয়েছে কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে জলে ঝাঁপ দিছে, কেউ বলে কুমিরে টেনে নিয়েছে অতলে। কিন্তু যে যাই বলুক, সোমত্ত মেয়েটি বাপকে খুঁজে। জল সাঁতরে-সাঁতরে সে গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চষে বেড়ায়। কাঁপা-কাঁপা গলায় ডাকে, আব্বা আবা ও আব্বা…

শেষে দূর গ্রামের কোনো এক পালতোলা নৌকা তাদের ঘাটের কাছ দিয়ে যাবার সময় জানিয়ে যায় মাঠের শেষে যে কবরস্থান, সেখানে কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে ঝুলে আছে একজন মানুষ। সকলে নৌকা-ভেলা যোগাড়-জন্তর করে সেদিকে যায়।  মেয়েটি আব্বা-আব্বা ডাকতে-ডাকতে জল সাঁতরে কবরস্থানের দিকে ছুটে। লোকজন গিয়ে দেখতে পায়, কৃষ্ণচূড়ার যে প্রধান ডালটি মাটি থেকে দুই পুরুষ সমান উচ্চতায় বিস্তৃত হয়ে আছে, সেখানে নিজের পুরাতন পাঞ্জাবি গলায় পেঁচিয়ে ঝুলে আছে ছামাদ মিয়া। লাশটি শক্ত কাঠের মতো হয়ে গেছে। গাছ থেকে লাশ নামিয়ে লোকজন তাকে সেখানেই সমাহিত করে আসে। বন্যার জল কিছুটা কমে আসায় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কিছুটা ভূমি ভেসে উঠেছে।

আমাদের সিএনজিটা গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ঠক্কর খেতে-খেতে চলে। দূরে কবরস্থানের ওপর বিশালাকার কৃষ্ণচূড়া গাছটির ছেয়ে থাকা লালফুল কিছুটাবিবর্ণ হয়ে কবরের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ছে।