কাফকার আসল রূপান্তর

আরিফুল হাসান

কাফকার আসল রূপান্তর শুরু হয় তাকে ঘর থেকে বাইরে ফেলে আসার পর। উদাম উত্তপ্ত রোদে সে পড়ে থাকে। দুপুরের বেলা, বাড়ন্ত সময়ে তার তখন প্রাণজীবনের বিপরীতে এক নিষ্প্রাণ বাস্তবতার আলোক অভিসার ঘটে। সে তখন টের পায়, আসলে আসল রূপান্তর শুরু হলো এতক্ষণে।
দুটো গাড়ি এসে পাশাপাশি দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে দুজন বাবুমতো লোক নামে। তারা গোঁফের পাকে আঙুল ডলতে ডলতে পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা বলে। কাফকা শুনতে পায় না। কিন্তু ওই আওয়াজগুলো, ওই বাকভঙ্গিগুলো তার কাছে ভয়ানক লাগে। সে ভয়ে মরে যেতে গিয়ে দেখে, সে তো ইতিমধ্যে মরেই গিয়েছে। এক অফুরান মৃত্যুহীন যন্ত্রণার মাঝে সে ভাসতে থাকে। এর থেকে তার কোনো মুক্তি নেই।
হেট! তাহলে কি তার কোনো মুক্তি নেই? এ যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? তাহলে কি মৃত্যু মানেই চূড়ান্ত সমাধান নয়। ভেবেছেÑ যাক, অন্তত মৃত্যু তাকে খালাস দিয়েছে পারিবারিক নিগ্রহ থেকে। এই মানবপোকার বেঁচে থাকা, কর্মহীন-ধর্মহীন অক্ষম দিনগুলোর সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু না, হয়নি। বাবুমতো লোক দুটি নাকে রুমাল গুঁজে তার আরও কাছে আসে। বস্তার ভেতর পা ভেঙে কুচকে-মুচকে পড়ে থাকা নিষ্প্রাণ কাফকাকে ইতস্তত হাতে টেনে বের করার চেষ্টা করে। তাদের হাতে ভারি গ্লাভস। কাফকা তার প্রাণহীন দেহটাকে প্রচ-ভাবে লুকিয়ে রাখতে চাইলো বস্তার ভেতরÑ ঠিকা ঝি যেটিতে ঢুকাতে তার দেহকে আরও কয়েকটি ভাঁজে ভেঙে ফেলেছে। তবু সে বস্তার ভেতরই গোপন থাকতে চায়। তার কেন যেন মনে হয়, জনব্যস্ততা তাকে আবারও যাপনের ন্যায় বিভ্রান্ত করবে এবং সে পুনরায় তার দুখের জীবনে ফিরে যাবে। কিন্তু না, তার নিষ্প্রাণ দেহের কোনো শক্তিপ্রয়োগই সম্ভব নয়। শুধু আত্মার ইচ্ছে ছাড়া এখন আর তার করার মতো কিছু নেই। জীবনে সে প্রার্থনায় বসেনি। তবু আজ প্রাণপণে ডাকলো ইশ্বরকে এবং ইশ্বর কোনো সাড়া না দিলে নিরুপায় হয়ে সে লোক দুটোর টানে বাইরে বেরিয়ে আসলো। এতে তার তিনজোড়া পায়ের চারটাই ভেঙে গেল এবং পিঠের ওপর গজিয়ে ওঠা পালক দুটোর একটি ওল্টে গেল।
কাফকার প্রতিবাদ কোনোই কাজে আসেনি এবং সে দুজন বাবু লোকের হস্তবন্দি হয়ে দ্রুত গাড়িতে ওঠে গেল। কিন্তু গাড়িতে ওঠার পরে দেখা গেল আসল সমস্যা। যে লোকের গাড়িতে উঠেছে সে লোকটি চালকের আসনে বসতেই অপর গাড়ি থেকে কি জানি কি মনে হওয়ায় ক্ষীপ্র গতিতে এগিয়ে এলো দ্বিতীয় লোকটি। হাত উঁচিয়ে প্রথম লোকটিকে গাড়ি না চালাতে বললো। কিন্তু প্রথম লোকটি যেন খেয়ালই করেনিÑÑ এমন ভাব নিয়ে গাড়ির চাবি ঘোরালো। গুরুং গুরুং শব্দে গাড়ি স্টার্ট নিল। দ্বিতীয় লোকটি প্রায় হুমড়ি খেয়ে এসে প্রথম লোকের গাড়িটিকে ধরে ফেলার চেষ্টা করলো কিন্তু পারল না। প্রথম লোকটি গাড়ি স্টার্ট দিয়েই গতি চূড়ায় তুলে ছুটতে লাগলো। কাফকার ইচ্ছে হলো বলতে, Ñভাই, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাবেন না। তার ভয় করতে লাগলো। আবার পরক্ষণেই ভয় কেটেও গেল। কিসের ভয় তার? মৃত্যুভয়? সে তো একবার মরেছেই। তাহলে আর ভয় কিসের? তবু তার বুকের ভেতর থেকে পুরোপুরি ভয় নামে না। সে দেখে, দ্বিতীয় গাড়িটা প্রথম গাড়িটার পেছনে পেছনে তিরবেগে আসছে এবং আশংকায় কাফকার বুক দুরুদুরু কাঁপতে থাকে। তার মনে হয়, এক্ষুণি একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে এবং ঘটলোও তাই। তাকে বহন করা যে গাড়িটা, তার চালক অর্থাৎ প্রথম ব্যক্তিটি হঠাৎ তার স্টিয়ারিঙের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং বড় রাস্তার মাঝে এঁকেবেঁকে চলতে থাকে। কাফকার মনে হয় এই বুঝি গাড়িটা ধাক্কা খেল কোনো কিছুর সাথে। এবং সত্যিই বড়সড় একটি শালগাছে ধাক্কা খেয়ে গাড়িটি ছিটকে পড়ে যায় রাস্তার একপাশে। ঘন জঙ্গল ও ঝোপের মাঝে গাড়িটিতে আগুন ধরবে ধরবে ভাব। কাফকাও একান্তভাবে চায় গাড়িটিতে আগুন ধরুক। তাহলে অন্তত তার মৃতদেহকে নিয়ে আর যাপন সংকট বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে তার রূপান্তরিত দেহটি এবং তারও মুক্তি মিলবে চিরতরে।
কিন্তু তার আশাপূরণ হয়নি। দ্বিতীয় গাড়িটা দ্রুত থামিয়ে লোকটি বেরিয়ে আসলো এবং প্রায় ঝাঁপিয়ে প্রথম গাড়িটার ওপর নামলো আর ধোঁয়া ওঠা গাড়িটা থেকে টেনে বের করলো কাফকাকে। তারপর হাতের রিভলবারটা উঁচিয়ে একে একে পাঁচটি গুলি ছুড়লো প্রথম গাড়ির চালকটির বুকে। অবশ্য লোকটি অনেক আগেই মারা গিয়েছে, কাফকা দেখেছে, শালগাছটিতে ধাক্কা লেগে লোকটির মাথা এতো জোরে স্টিয়ারিঙের সাথে ধাক্কা লাগে যে, তার মস্তক দুভাগ হয়ে মগজগুলো ছিটকে পড়ে গাড়িময়। চালকটি একটি আওয়াজও করার সুযোগ পায়নি। যেন শীতের বৃক্ষ থেকে টুক করে খসে গেল একটি পাতা।
দ্বিতীয় লোকটি পাঁচটি গুলি ছোড়ার পরও আবার ট্রিগার টানলো। ক্র্যাক করে আওয়াজ আসলো শুধু। কাফকা ধারণা করে নিল, তাহলে তার রিভলবারে পাঁচটা গুলিই ছিল! তাহলে আরেকটা গুলি গেল কোথায়। এবার তার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়, আসলে প্রথম লোকটি গাড়ির নিয়ন্ত্রণ অকারণেই হারিয়ে ফেলেনি, মূলত দ্বিতীয় লোকটি পেছন থেকে গুলি করেছে গাড়িটির চাকায়। আর এর ফলেই ঘটেছে দুর্ঘটনাটি। তবে একটি জিনিস সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, মানুষগুলোকে তার কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিকভাবে চিনতে পারছে না তাদের।
দ্বিতীয় লোকটি অতঃপর কাফকাকে নিয়ে সোজা উত্তর দিকে যেতে থাকে। ছোট্ট একটি পাহাড় পেরিয়ে ঘন সবুজবনের ভেতর দিয়ে একটি বিমোহিত রাস্তা ধরে গাড়ি চালাচ্ছে সে। কাফকার একবার ইচ্ছে হয় গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে থেকে যায় এই বনে। আহা, রূপান্তরের প্রথম দিন থেকে যদি সে এমন একটি সবুজবনে থাকতে পারতো তাহলে হয়তো তার মৃত্যু এত তাড়াতাড়ি, এত যন্ত্রণাদায়ক হত না। হয়তো নিষ্কৃতি পেতো তার বাবা-মা এবং আদরের বোনটিও। তার প্রতি বিরক্ত হতো না। গাড়ির কাচ লাগানো, তা না হলেও সে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়তে পারতো না। কারণ তখন সে কাফকা নয়, কাফকার লাশ।
দ্বিতীয় লোকটি সবুজবনের ভেতর দিয়ে অচেনা সব রাস্তা-অরাস্তা ধরে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালায় এবং সবশেষে জঙ্গল পেরিয়ে আরেকটি পাহাড়ের কাছে এসে গাড়িটি থামায়। পাহাড়ের চুড়ো ছুঁয়ে মেঘ তার বিস্তৃত ডানা মেলে রেখেছে। কাফকার ইচ্ছে হয়Ñ ইশ্ সে যদি মেঘের ডানায় ওড়ে যেতে পারতো! কিন্তু অসহায় হয়ে গাড়ির ভেতর পড়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। গাড়ির কাচ গলে তার দৃষ্টি চলে যায় পাহাড়ের উপত্যকায়। সারি সারি লোহার ঘরগুলো দেখে বুঝতে পারে, এটি কোনো গোপন গবেষণাকেন্দ্র। এমন সময় হঠাৎ পাহাড়ের চুড়ো থেকে অতর্কিতে একটি বৃহদাকার পাথর গাড়ির সম্মুখভাগে পড়ে এবং চালকসহ গাড়ির ইঞ্জিন অংশটি থেঁতলে যায় পাথুরে ভূমির সাথে। কাফকা খেয়াল করে, আরেকট ুহলেই চালকের সাথে সেও থেঁতলে যেতো। সে অনুমান করে, কেউ ইচ্ছে করেই দ্বিতীয় লোকটিকে হত্যা করেছে এবং কাফকাকে সে হরণ করতে চায়। তার ধারণা সত্যি করে এবার তৃতীয় লোকটি হাসতে-হাসতে পাহাড় থেকে নেমে আসে। কাফকা লোকটিকে চিনতে পারে, হ্যাঁ, এই তিনজন লোকই তাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতো। তৃতীয় লোকটি গাড়ির দরজা খুলে কাফকাকে টেনে বের করে এবং উল্লাসে ফেটে পড়ে বলে, এই বিশেষ প্রাণিটির জন্য আমি পাবো অর্ধেকটা রাজত্বের সমান অর্থ। কাফকা বুঝতে পারে, তৃতীয় লোকটির উদ্দেশ্য সফল হতে যাচ্ছে। কিন্তু গবেষণাকেন্দ্রে বিক্রি করে দেবার পর কাফকার আর কী কী রূপান্তর ঘটবে, তা সে আন্দাজ করতে পারে না।