করোনা প্রতিরোধে সামগ্রিক সহযোগিতা ও সচেতনতা জরুরি

রায়হান আহমেদ তপাদার :

গত বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর আমরা অনেকটা সময় পেয়েছি। করোনা সংক্রমণ রোধে আমাদের করণীয়গুলো আমরা সঠিকভাবে পরিপালন করতে পারিনি। ফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থানে এসেছে এবং লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারকে। আমাদের হাতে তথ্যের বড় ঘাটতি রয়েছে। করোনা সংক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে বিশেষ করে কোন বয়সের মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সে বিষয়ে তেমন গবেষণা হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে পঞ্চাশোর্ধরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাদের যদি নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা যেত তাহলে প্রাণহানি হয়তো কমত। বাড়ি থেকে যারা বাইরে কাজ করতে যাবে তাদের থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের পুরোপুরি আলাদা করে রাখতে হবে। কারণ সংক্রমণ বাড়ছে যারা বাইরে যাচ্ছে তাদের মাধ্যমে। তারাই ভাইরাস বহন করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে এবং এতে অন্যরা আক্রান্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে শুরুতেই জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। এখন উচিত হবে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তরুণ ও বয়স্কদের আলাদা করা। বয়স্কদের বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। এটা করা না গেলে সংক্রমণ রোধ করা যাবে না।বাংলাদেশে এখনো শতকরা ১০ জনকেও টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আমরা যারা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছি তার অ্যান্টিবডি তৈরি হতেও ১৫-২০ দিন সময় লাগবে। দ্বিতীয় ডোজের টিকা প্রদান শুরু হয়েছে।

কিন্তু ইতোমধ্যেই আমাদের এক ধরনের খেয়ালিপনা, অসতর্কতা, অবহেলা ও গা-ছাড়া ভাব দৃশ্যমান। হরহামেশাই চলছে পারিবারিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি। কিন্তু বলা উচিত, সরকার এই ভয়ংকর করোনা মহামারি থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য টিকা প্রয়োগসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। লকডাউন তুলে নিয়ে জীবন-জীবিকার মানবিক কারণে করোনা রোধে স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক আইনের প্রয়োগে শিথিলতার কারণে দেশ আবার করোনার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। তাই সরকার সংক্রমণের লাগাম টানতে আঠারো দফা নির্দেশনা দিলেও তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। তাই সরকারের উচিত, হবে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে বিধিনিষেধ মানতে আরো কঠোর হওয়া। তাছাড়া দেশে এই পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ছয় লাখের ঊর্ধ্বে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ৯ হাজারের ওপরে। কিন্তু এখনো আমাদের মধ্যে কোনো হুঁশ নেই। এছাড়া ইতোমধ্যে দেশে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে। নতুন স্টেইনট্রি উপযুক্ত পরিবেশ পেলে দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক সপ্তাহ লকডাউনের কথা জানিয়ে তিনি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার অনুরোধ করেন, মাস্ক পরতে বলেন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলেন। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতা ও সচেতনতার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করা খুবই জরুরি।

আমাদের নিজেদের সুস্থতার জন্য সরকারের দেয়া নিয়ম-নীতি মেনে চলা দেশের সব মানুষের দায়িত্ব বলে মনে করছি। আজ সমগ্র বিশ্ব এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে। তাই সরকারের প্রতি আস্থা রেখে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।অতিমারির প্রকোপে যখন জর্জরিত গোটা বিশ্ব, সেই সময় গত বছর ৫ জুলাই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৭ দিনের চলন্ত গড় ছিল ৪৪.৮৬। মার্চে তা ১০-এর নিচে নেমে এলেও, সম্প্রতি ফের তা বেড়ে ৪৬.৪৩ হয়েছে। তার জেরেই লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তরফে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত সাত লক্ষের বেশি মানুষের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছেন ১০ হাজারের বেশি।

আমরা মনে করি, দেশের জনগণের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি আরো বাড়তে হবে। নানা কর্মকা-ে মনে হচ্ছে জনগণ এখন এই বিপদ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয়। ৭ দিনের লকডাউন ঘোষণার পর লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অথচ ঘরে থাকার জন্য এই নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। সবচেয়ে বড় কথা, জোরদার ও আগ্রাসী পদক্ষেপ ছাড়া এই ভাইরাস মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে হয় না। সাময়িক কষ্ট হলেও দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য সরকারের দেয়া নির্দেশনা আমাদের মানতে হবে।

আমাদের ঘরে থাকতে হবে। নিজে ভালো থাকতে হবে এবং অন্যকেও ভালো রাখতে হবে। আর শুধু সরকারের দিকে না চেয়ে আমাদের যে কাজগুলো করতে বলা হচ্ছে, সেগুলো করে যেতে হবে। এ লড়াই কিন্তু অনেক দিনের। দেশের এমন চরম সংকটে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করতে হবে। তাহলে আমাদের মুক্তি মিলবে। ব্যাপক প্রাণহানি থেকে আমরা রক্ষা পাব। করোনা ভাইরাসের নাজুক পরিস্থিতি বিবেচনায় শর্ত সাপেক্ষে সার্বিক কার্যাবলি বা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সরকারি সিদ্ধান্তকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানাই। এর আগেও প্রশাসনের তরফ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ ১৮ দফা নির্দেশনাও জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে; যেভাবে ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে; যেভাবে হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ছে এবং প্রয়োজনীয় সেবা ও অক্সিজেনের অভাব দেখা দিচ্ছে; তাতে ‘লকডাউন’-এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের অবকাশ নেই। তবে গত বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, এ পরিস্থিতিতে অনেকেই সংকটে পড়েন। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি যারা দিনে এনে দিনে খায়, তাদের অনেকের আয় বন্ধ হয়ে যায়। পরিবহন বন্ধ থাকায় এর সঙ্গে সংশ্নিষ্টরাসহ বন্ধ থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও সমস্যায় পড়েন। আমাদের মনে আছে, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত বছর ঈদ ও পহেলা বৈশাখের বাজার ধরতে না পেরে স্থানীয় বাজারকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছিলেন।অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়েছিল, কেউ বিনা বেতনে ছুটি দিয়েছিল।

এবারও রমজান মাসের আগে লকডাউনের ঘোষণায় ব্যবসায়ীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়া স্বাভাবিক। সরকারি প্রজ্ঞাপনে সাত দিনের কথা বলা হলেও ‘লকডাউন’ যে আরও দীর্ঘতর হবে, পরিস্থিতি বিশ্নেষণে সহজেই অনুমেয়।বলা বাহুল্য, দেখতে দেখতে করোনা নামের ভয়ংকর এই অদৃশ্য রোগটি এক বছর অতিক্রম করেছে। দেশব্যাপী নানা গুজব, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে অতিবাহিত হলেও ভাইরাসটির টিকা কার্যক্রম শুরু হওয়া আমাদের জন্য সুখবর। কিন্তু ভারত থেকে টিকা আসার পর থেকে মানুষ অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। সবার ধারণা, টিকা দিলে আর করোনা সংক্রমিত হবে না। আবার অনেকে টিকা দিয়ে মানছে না স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব¡। কিন্তু টিকার অতি উচ্ছ্বাসে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে আগামীতে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। অথচ করোনা সংক্রমণের শুরুতে এবং লকডাউন চলাকালীন সময়ে সবাই যেভাবে পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, গগলস ও গাউন ব্যবহার করত তা এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যার কারণে দেশে হু হু করে আবার বেড়ে চলেছে করোনা সংক্রমণ।

বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলে আসছে টিকা গ্রহণ করেও যথাযথভাবে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। এমনকি স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরিধানে রয়েছে চরম অনীহা।আঠারো দফা নির্দেশনায় জনগণ কিছুটা সতর্ক হলেও তাও এই ভয়াবহ করোনার সংক্রমণ রোধের জন্য যথেষ্ট নয়।আজ বন্দি ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইরিত্রিয়া বন্দি আফগানিস্তান, ইউএসএ, আজ বন্দি হোক গোটা বিশ্ব!

শুধু এই লিমিটেড লকডাউনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। সরকারকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ল-ভ- হয়ে পড়ে আছে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম। শুধু পাঠদান নয়, একের পর এক বাতিল হচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষাও। কিন্তু যেসব ছাত্র বিগত লকডাউন চলাকালীন সময়ে ঘর বন্দি ছিল কিংবা স্বাস্থ্যবিধি কিছুটাও হলে মানত এখন তারা ঘরবন্দি নেই। খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা অলিতে-গলিতে জটলা করে সময় পার করছে। লক্ষ্য করলে দেখবেন তাদেরও একই অবস্থা। স্বাস্থ্যবিধি মানার হার অতি নগণ্য। এই মরণব্যাধি থেকে নিজেকে পরিবার-পরিজন ও অন্যান্য আপনজনকে বাঁচাতে মাস্ক পরিধান, সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মানা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আবার দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশের কোন কোন মহল করোনাকালীন সরকারের সাফল্য ও ভারত থেকে টিকা আনাকে ভালো চোখে দেখছে না। সরকারের উচিত হবে পুরো দেশকে করোনা ভাইরাসের হুমকি থেকে বাঁচাতে যথাযথ সতর্ক ও নজর রাখা। প্রয়োজনের মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মানতে আইনের প্রয়োগ করা। পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার পূর্বেই নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা করা। যদি কা-জ্ঞানহীন প্রবণতার লাগাম টানা সম্ভব না হয় তাহলে দিন দিন সংক্রমণ শুধু ঊর্ধ্বমুখী নয়, এই ভয়ংকর করোনা ভাইরাসের মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুসারে প্রশাসন মানুষকে বাইরে যেতে নিবৃত্ত রাখতে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা থেকে মুক্তি পেতে সকলেরই উচিত লকডাউন মেনে চলে নিজেকে, স্বজন ও প্রতিবেশীদের সুরক্ষা করা।

 

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

ই- মেইল : [email protected]