কমছে জলাশয়, বাড়ছে গরম

অপরিকল্পিত নগরায়ণ
১৫ বছরে হারিয়ে গেছে ৩ হাজার পুকুর ও জলাশয়

ভূঁইয়া নজরুল
উত্তর কাট্টলী প্রশান্তি আবাসিক এলাকা। গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন। কিন্তু এখানেই ছিল একটি বিশাল দীঘি। কাট্টলী দীঘি নামে পরিচিত এই দীঘিটি ভরাট করে ৯০ এর দশকের শেষের দিকে গড়ে উঠেছে আজকের প্রশান্তি আবাসিক এলাকা।
শুধু প্রশান্তি আবাসিক এলাকা নয়, নগরীর অনেক এলাকায় এভাবে পুকুর ও দীঘি ভরাট করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ভূমিদস্যুদের লোভী তৎপরতায় দিন দিন কমছে জলাশয়, নগরীতে বাড়ছে তপ্ত আবহাওয়া। নগরীতে পুকুর-দীঘি জলাশয় ভরাট জলাধার সংরক্ষণ আইনে নিষিদ্ধ হলেও প্রতিনিয়ত ভরাট কার্যক্রম চলছে।
এবিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নুরুল্লাহ নূরী বলেন, ‘পুকুর-দীঘি ও জলাশয় পরিবেশকে শীতল রাখে। এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই জলাধার সংরক্ষণ আইনেও এগুলো ভরাট করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই আইন কার্যকর রাখতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করি।’
কিন্তু একটি নগরের জন্য অবশ্যই জলাধার ও সবুজায়ন স্পেশ থাকতে হবে উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ, নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি নগরের জন্য সবুজায়ন ও জলাশয় অবশ্যই রাখতে হবে। এতে নগরীর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সহায়ক হয়। একইসাথে প্রতিটি ভবনের প্লটের নির্ধারিত একটি অংশ খালি রাখতে হয়। সেই স্থানে সবুজায়ন এবং মাটির নিচের পানি যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়। এসব করা গেলে নগরীর পরিবেশের ভারসাম্য থাকে।
তিনি আরো বলেন, জলাধার ও সবুজায়ন রক্ষায় আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা যায় না। এসব কমে গেলে নগরীতে গরমের মাত্রা বাড়বে তা বুঝার পরও তা মেনে চলি না। আর এতেই নগরীর তাপমাত্রা বাড়ছে এবং উত্তপ্ত হচ্ছে পরিবেশ।
জান গেছে, ২০০৬-০৭ সালে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের আওতায় পরিচালিত সার্ভেতে নগরীতে ৪ হাজার ৫২৩টি পুকুর-জলাশয়ের অস্তিত্ব পেয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ২০০৮ সালের ড্যাপের নির্দেশনায় এসব পুকুর ও জলাশয় রক্ষার জন্য নির্দেশনা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সিডিএ ড্যাপের উল্লেখিত ধারা সংশোধন করে শূন্য দশমিক ৫০ একরের (৩০ কাঠা) আয়তনের বড় পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা যাবে না, এর কম আয়তনের পুকুরের ক্ষেত্রে সিডিএ থেকে অনুমোদন নিতে হবে বলে পরিপত্র জারি করে। আর এই নির্দেশনার পরপরই নগরীর পুকুর-দীঘি জলাশয় ভরাট কার্যক্রম ত্বরান্বিত হয়। একথা স্বীকার করে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘যদিও আইনে বলা হয়েছে এই আধা একরের বড় আয়তনের পুকুর ভরাট করা যাবে না। কিন্তু সুবিধাভোগী চক্র বড় আয়তনের পুকুরগুলোকে মাজা পুকুর কিংবা ধীরে ধীরে ভরাট করে আধা একরের চেয়ে ছোট জলাশয়ে পরিণত করে। বর্তমানে পুকুরের সংখ্যা কমতে কমতে দেড় হাজারে এসে ঠেকেছে মনে হচ্ছে।’ এহিসেবে গত ১৫ বছরে তিন হাজার পুকুর ও জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে নগরীতে।
তিনি আরো বলেন, তারপরও পুকুরটি ব্যবহার অনুপযোগী বলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রত্যয়নপত্র দেয়ার পর আমরা অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করি। তবে একথা সঠিক যে দিন দিন পুকুর জলাশয়ের পরিমাণ কমছে এবং নগরীর আবহাওয়া উত্তপ্ত হতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
পুকুর জলাশয় ভরাট হওয়ার পাশাপাশি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবনের এক তৃতীয়াংশ জমি খালি রাখার বিধান রাখলেও তা কেউ মানছে বলে জানান নগর পরিকল্পিনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন। তিনি বলেন, একটি নগরীর জন্য পর্যাপ্ত খালি জায়গা রাখা প্রয়োজন। পুকুর, জলাশয়, খালি জায়গা এবং উন্মক্ত সবুজ স্থানগুলো গরমের তীব্রতাকে কমিয়ে আনে। এখন নগরগুলোতে কেউ তা মানছে বলে নগরগুলো উত্তপ্ত হচ্ছে এবং দুর্ভোগ বাড়ছে।
নগরায়ণের থাবায় বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল করার সময় মাইল্যার দীঘি, চকবাজারের কিশলয় কমিউনিটি সেন্টার এর স্থানে ছিল কমলদহ দীঘি, ভরাট হয়ে গেছে মধ্য রামপুরার হাজার দীঘি, মুরাদপুর মোহাম্মদপুরের বড় দীঘি, কাট্টলী সাহেরপাড়ার পদ্ম পুকুরসহ অসংখ্য পুকুর।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে গত কিছুদিন ধরে তীব্র গরম পড়ছে। তাপমাত্রার পারদ বাড়ছেই। ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ২০১৫ সালের পর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। ২৯ এপ্রিলের আগে তাপমাত্রা কমার কোনো সম্ভাবনাও নেই। গ্রামের চেয়ে শহরের গরমের তীব্রতা বেশি অনুভূত হচ্ছে। আর এতে পরিবেশ ধসে মানুষের ভূমিকাই মুখ্য।