এসপিএম : বছরে খালাস হবে ৯ মিলিয়ন টন তেল

বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা

সুপ্রভাত ডেস্ক

কক্সবাজারের মহেশখালীতে আমদানি করা জ্বালানি তেল জাহাজ থেকে দ্রুত ও সাশ্রয়ীভাবে খালাসের জন্য ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন সম্পন্ন হতে যাওয়া প্রকল্পটির মাধ্যমে চলতি বছরেই গভীর সমুদ্রে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে পাইপলাইনে মহেশখালীতে নির্মিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কে আসবে জ্বালানি তেল। প্রকল্পটি চালু হলে তেল খালাসে লাগবে না আর লাইটার জাহাজ। আগে যে পরিমাণ তেল খালাস করতে ১১ দিন সময় লাগতো, সেখানে এখন লাগবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। এতে পরিবহন খরচ ও অপচয় হ্রাস পেয়ে বাৎসরিক ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। সেই সঙ্গে ঝুঁকিও কমবে অনেক। খবর জাগোনিউজ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের নাব্য কম ও চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা থাকায় বড় ক্রুড ভেসেলগুলো নোঙর করে লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে ক্রুড আনলোড করা হয়। এতে সময় অনেক বেশি লাগে। এটি ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিও অনেক। ফলে আমদানি করা জ্বালানি তেল জাহাজ থেকে সহজে, নিরাপদে, স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে খালাস করার জন্য ২০১৫ সালের নভেম্বরে কক্সবাজারের মহেশখালীতে বন বিভাগ থেকে ১৯১ একর জায়গা নিয়ে নির্মাণ করা হয় এসপিএম প্রকল্প। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সরাসরি জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল সমুদ্রের তলদেশের পাইপলাইনের মাধ্যমে শোর ট্যাঙ্কে নেবে।
প্রকল্পটি থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে এসপিএম বয়া মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম পাশে (বঙ্গোপসাগরে) স্থাপন করা হয়েছে। জাহাজ থেকে তেল সরাসরি পাম্প করা হবে যা এসপিএম হয়ে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মাতারবাড়ি এলটিই (ল্যান্ড টার্মিনাল এন্ড) পর্যন্ত ও সেখান থেকে অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় নির্মিত স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল আনলোড করা হবে। এরমাধ্যমে পাইপলাইনের মাধ্যমে কেইপিজেডের ভেতর দিয়ে ডাংগারচর পর্যন্ত এসে কর্ণফুলী নদী এইচডিডি পদ্ধতির মাধ্যমে ক্রস করে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভেতর দিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পাঠানো হবে। ট্যাংক ফার্ম থেকে ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল ডেলিভারি করা হবে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) পরিশোধন ক্ষমতা এখন বছরে ১৫ লাখ টন। নির্মাণাধীন ইউনিট-টু প্রকল্প চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা বছরে ৪৫ লাখ টনে দাঁড়াবে। অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয়। আমদানি করা জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়াতে এসপিএমসহ পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য ও সরেজমিনে দেখা গেছে, এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূলে ৫০ হাজার কিলোলিটার ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, ৩৬ হাজার কিলোলিটার ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাঙ্ক এবং মহেশখালীতে পাম্প স্টেশন স্থাপন, বুস্টার পাম্প, জেনারেটর, মিটারিং স্টেশন, পিগিং স্টেশন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে অফশোরে ১৪৬ কিলোমিটার এবং অনশোরে ৭৪ কিলোমিটারসহ মোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় যোগাযোগের জন্য সড়ক ও বিদ্যুতের সার্বক্ষণিক ব্যবস্থাসহ রয়েছে আবাসন ব্যবস্থাও।
পাহাড়ের উপর গড়ে তোলা এই প্রকল্পটির নিরাপত্তার জন্য দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তা ও প্রকল্প এলাকা দেখাশোনার জন্য কয়েকশ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরাও।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৬.৫৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৯৭ শতাংশ। প্রকল্পটি চালু হলে ১১ দিনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল খালাস করা যায়, সেটির সময় কমে আসবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর লাইটারেজ জাহাজের প্রয়োজন হবে না। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে বাস্তবায়নাধীন সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং পাইপলাইন দিয়ে স্বল্প সময়ে, সাশ্রয়ী খরচে ও নিরাপদে জ্বালানি তেল (ক্রুড ওয়েল ও ফিনিসড প্রোডাক্ট) পরিবহন করা হবে। এতে পরিবহন খরচ ও অপচয় হ্রাস পেয়ে সরকারের বাৎসরিক ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
প্রকল্প কর্মকর্তা মনজেদ আলী শান্ত বলেন, প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। ১৯১ একর জমির উপর নির্মিত এই প্রকল্পটির ৯৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের যেকোনো সময় এটি চালু হতে পারে। আগে যেখানে জাহাজ ভর্তি অপরিশোধিত তেলগুলো আসতো সেই তেল মাদার ভেসেল থেকে লাইটারিং করে চট্টগ্রামে নেওয়া হতো। এতে ১১ থেকে ১২ দিন সময় লাগার পাশাপাশি অনেক ব্যয় হতো। প্রকল্পটি থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বয়াতে মাদার ভেসেল মুরিং করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা একটি জাহাজ খালাস করতে পারবো। সেখান থেকে তেলগুলো আমরা তিনটি ফিনিশ ও তিনটি ক্রুড ট্যাংকে রেখে সরবরাহ করতে পারবো। এতে বছরে আমাদের ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। বছরে ৯ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল খালাস করা যাবে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটির টেস্টিং শুরু হয়েছিল। কিন্তু ছোট একটি দুর্ঘটনার কারণে দেরি হচ্ছে। এর একটি প্রতিবেদন আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। তারা শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কোম্পানি হতে যাচ্ছে। এতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলেও জানান তিনি।
মহেশখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়াছিন বলেন, এটি একটি জাতীয় প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়বে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে এই প্রকল্প চালু হলে ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। আর এই ৮০০ কোটি টাকা আমাদের রিজার্ভে যুক্ত হবে। অপরিশোধিত তেল শোধনের জন্য জাতীয় এই প্রকল্পটি চালু হলে দেশের জ্বালানি খাতেও পরিবর্তন আসবে। সেই সঙ্গে মহেশখালীর যোগাযোগ ও মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নে প্রভাব পড়বে। এছাড়া অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে যার ফল পেতে পারে এই অঞ্চলের মানুষ।