আল্বিদা ইয়া শাহ্রা রমাদ্বান

হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনই সমস্ত হামদ, সানা, প্রশংসা ও স্তুতির প্রকৃত হকদার, স্থান-কাল, জীব-জড় সবকিছুই যাঁর নিয়ন্ত্রণে। তাঁর পবিত্রতার জয়গান করি, যিনি তাঁর ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্ত আরোপ করেছেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, যিনি আমাদের জীবনে আরেকবার আলবিদা’র জুমা পড়ার অবকাশ দিলেন।
আল্লাহ্র একত্ব ঘোষণা করি, তাঁর শান, ‘ওয়াহ্দাহু লা-শরীক’। তিনি সকল সৃষ্টির ¯্রষ্টা, রিয্কদাতা, পালনকর্তা। তাঁর সমকক্ষ বা শরীক নাই। সমগ্র সৃষ্টির পরিবর্তন, বিবর্তন, বিনাশ, আমাদের পুনরুত্থান, বিচার-বিধান সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। আমাদের কা-ারী, কর্ণধার, আল্লাহ্র পরিচয় দানকারী, তাঁর পথে আহ্বানকারী সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র বান্দা ও তাঁর রাসূল।
মাহে রমাদ্বান বিদায়োম্মুখ। মহান এ মাসের আজ শেষ জুমা, বিদায়ী জুমা’। আমাদের মৃত্যু যেমন নিশ্চিত, অবশ্যম্ভাবী, জীবনের স্থিতি তেমনই অনিশ্চিত, অনির্ধারিত। আগামী রমাদ্বান শরীফ আবার পাওয়া যাবেÑ সে নিশ্চয়তা নেই। অনেকের এটা এক বছরের জন্যই নয়; হয়তো জীবনের সর্বশেষ রমাদ্বান এবং জুমাতুল বিদা।
একমাস ব্যাপী আমরা রোযা পালন করেছি। রোযার সংশ্লিষ্ট সাহ্রী ও ইফতার গ্রহণ করেছি। সারাদিন রোযার ক্লান্তি, অবসাদ ঠেলে ইশা’র পর তারাভীহ্’র নামায, এতদসঙ্গে কুরআন মজীদ’র তেলাওয়াত’র ধারাবাহিক শ্রবণে খতমে কুরআন আদায়, ই’তিকাফ ইত্যাদির উৎসবমুখর পরিবেশ-আবার এগারো মাসের জন্য বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। বিদায়ের সুর সর্বত্রই যে করুণ! সাধক বান্দাদের বন্দেগী রিয়াযত’র যে পুলক তৃপ্তি সে কি আর পাওয়া যাবে? স্বভাবতঃ সাধক চিত্ত বিরহ কাতর। প্রিয়স্থান, প্রিয়জন, প্রিয়ক্ষণ-বিচ্ছিন্ন হতে দারুণ কষ্ট বৈকি। বিদায় নিচ্ছে প্রিয় মাসের সেই কাক্সিক্ষত, বাঞ্ছিত মুহূর্তগুলো। বিদায় হে প্রিয়তম মাস, তোমার প্রতি ক্ষণ, প্রতি মুহূর্তের স্মৃতি বেদনা জাগানিয়া, জানি না জীবনে আবার দেখা হবে কিনা আল্বিদা ইয়া শাহ্রা রমাদ্বান। এ জীবনে তুমি এসো বার বার।
আমাদের জীবনের সর্বোত্তম আদর্শ উসওয়ায়ে হাসানা’র ধারক-বাহক, খুলুকে আযীম’র মূর্ত প্রতীক প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), যাঁর কারণে আমরা লাভ করেছি পার্থিব-অপার্থিব সমস্ত নেয়ামতের দিক নির্দেশনা মহাগ্রন্থ কুরআন মাজীদ। সেই কুরআনের ব্যবহারিক রূপ সুন্নাতে মুস্তফা। কুরআন লাভের কৃতজ্ঞতায় মাসভর সিয়াম’র কৃচ্ছ্র সাধন পাপ-পঙ্কিল জীবনটাতে কিছুটা রহমত’র হিমেল পরশ এনেছিল অনেক কল্যাণকর পরিবর্তন। মাহে রমাদ্বান যেন জীয়নকাঠির ছোঁয়া লাগিয়েছিল মুমিন জীবনে। আজ সেই পুণ্যের মধুমাসকে পাথরচাপা বুকে, ক্রন্দসী চোখে, কম্পিত মুখে বুঝি বলতেই হচ্ছে ‘আলবিদা’, ইয়া শাহরাল কুরআন, ইয়া শাহ্রাস সিয়াম। বিদায় হে, রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। আবার যেন সাক্ষাত হয়।
বিদায়ী এ খুৎবায় সংকলিত আয়াত খানির বারতা কী, তা লক্ষ্য করা যাক। বিচার দিবসের মালিক আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে, মুত্তাকী বান্দাগণ থাকবেন নিরাপদ নিবাসে, ঝর্ণাধারায়, বেহেশত-কাননে। মিহি ও পুরু রেশমের পোশাক পরিধান করতঃ সামনা সামনি উপবেশন করবেন। এমনই হবে (তাঁদের প্রতিদান)। আর আমি ডাগর নয়না (বেহেশতী) হুরদেরকে তাঁদের সঙ্গী বানিয়ে দেবো’। (সুরা দুখান : ৫১-৫৪) উক্ত আয়াতে মুত্তাকী বান্দাদের পুরস্কার ও প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে। সেখানে তাঁরা থাকবেন প্রথমতঃ নিরাপদে অর্থাৎ আল্লাহ্ তাঁদের পুর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখবেন। তাঁদের স্বস্তি ও আরামের কোন রূপ ব্যাঘাত ঘটবে না, অবাঞ্ছিত কারো অনুপ্রবেশের কোন সম্ভাবনা থাকবেনা। আর তাঁদের প্রশান্তি ও মনের আনন্দ নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য নয়নাভিরাম, মনোহর, সুদৃশ্য উদ্যানরাজি সাজানো থাকবে যেগুলোর তলদেশে থাকবে প্রবাহমান ঝর্ণাধারা। তাঁদের ¯িœগ্ধ শোভায় শুধু চোখ জুড়াবে না; তাঁদের পরনে থাকবে মিহি ও মোটা রেশমের শৌখিন পোশাক। সর্বোপরি মনোরঞ্জনের সঙ্গী হিসাবে রাখা হবে জান্নাতী হুরগণ। তাঁরা তাঁদের বৈধ সঙ্গীনী হিসাবে অবস্থান করবেন।
লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হবে যে, বর্ণিত পুরস্কার, প্রতিদান কাদের জন্য বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে, মুত্তাকী বা তাকওয়াবান বান্দাদের জন্য। এর অর্থ পরহেযগার, খোদাভীরু। ‘তাকওয়া’ শব্দের অর্থ ভয় করা, বেঁচে থাকা। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্র শাস্তি বা তাঁর অসন্তোষ হতে ভয় করত তাঁর অসন্তুষ্টি ও শাস্তিযোগ্য সমস্ত অপকর্ম হতে বেঁচে থাকাই তাকওয়া। এর প্রতিদান ঘোষিত হয়েছে বর্ণিত আয়াতে। পৃথিবীতে বাধ্য-অবাধ্য নির্বিশেষে প্রত্যেক বান্দাই কিন্তু পরকালের এ পুরস্কার কামনা করে। স্মরণ রাখা উচিত যে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে পরকালে যাত্রা করবেই, না করে উপায় নেই। তাই, সে কালের অর্থাৎ মরণোত্তর পরকালের সদগতির কথা ভাবা কি দূরদর্শী, বিবেচক মানুষের উচিত নয়?
সঠিক মুত্তাকী কারা? যারা শুধু লোকচক্ষুর সামনেই নয়; বরং যাঁরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আল্লাহর ভয়ে সব অপরাধমূলক কর্মকা- হতে নিজকে বাঁচিয়ে চলেন। সেই প্রকৃত মুত্তাকী হওয়ার অনুশীলই সিয়াম বা রোযা । এক মাস নিষ্ঠার সাথে সিয়াম সাধনা পালন করা গেলে নফস’র অবদমন হয়, আর পাপ-প্রবৃত্তির বাসনা দুর্বল হয়। যে আল্লাহ্র অসন্তোষ ভয় করে সিয়াম’র সাধনা, তিনি প্রকাশ্যেও দেখেন, অপ্রকাশ্যে বান্দার আচরণও দেখেন। আলোতে আমরা ভালো মানুষ, অন্ধকারে আমাদের সেই রূপটি থাকলো কিনা তা আল্লাহ্ দেখছেন। শুধু বাইরের নয়, তিনি অন্তরের খবরও রাখেন, তিনি অন্তর্যামী। রোযাদার যে সারাদিন আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য রোযা রাখেন, বাইরে থেকে তা বুঝার উপায় নেই। কারণ, ভোগের ব্যাপার দৃশ্যমান; কিন্তু ত্যগের বিষয় দৃশ্যমান নয়। সে আড়ালে অন্ধকারে, খানা-পিনা, ভোগ-সম্ভোগ করলেও লোকে জানবে না। কিন্তু, সত্যিকার রোযাদার আড়ালে-অন্ধকারেও তা করেন না। কারণ তিনি অন্তর্যামী সর্বদ্রষ্টা, আল্লাহর জন্য রোযা রাখেন। তাই, আল্লাহর বাণী হাদীসে কুদসীর ঘোষণা, ‘রোযা আমারই জন্য, তার পুরস্কার ও আমিই দেবো’। আল্লাহ্ প্রেমিক রোযাদার’র প্রকৃতি ভিন্ন। তাঁরা তাঁর প্রেমে শুধু খানাÑপিনাই নয়: বরং আল্লাহর অপছন্দের সমস্ত আচরণও বর্জন করেন। মিথ্যা, চুরি, হারাম কাজই নয়, তাঁর অপছন্দের স্বভাবগুলোও ত্যাগ করেন। যেমন হিংসা, লোভ, অহঙ্কার-এক কথায় অন্তর্নিহিত দোষত্রুটি, যা আল্লাহ্র রাসূলের অপছন্দ তা সবই ঘৃণা ভরে, বর্জন করে চলেন। তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রভুর অসন্তুষ্টিমূলক সবকিছু থেকে বিরত থেকে আজীবন তাঁরা আচরণগত সিয়াম’র সাধনা করেন। মহান রব সিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন, যাতে তোমরা মুক্তাকী হতে পারো। সমীকরণ মিলল, রোযার সাধনায় বান্দা মুত্তাকী হয়, আর মুত্তাকীর জন্য আয়াতে ঘোষিত সেই পুরস্কার।
এ মাসের নিভৃত সাধনায় বান্দা আল্লাহ্র এতটাই প্রিয় হয়ে ওঠে যে, তাঁর মুখের ঘ্রাণ ও আল্লাহ্র কাছে মেশক আম্বর হতে প্রিয়তর বিবেচিত হয়। হযরত আনাস (রাদ্বি.) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, ‘রোযাদারগণ ক্বিয়ামতের দিন নিজ নিজ কবর হতে বের হলে তাঁদের পবিত্র মুখ নিঃসৃত সুঘ্রাণ হতে তাদের চেনা যাবে, যা হবে মেশক আম্বর হতে সুগন্ধময়’। বিদায়ী এ মাসটি যখন আসে-তখন প্রথম রাত হতে আর্শের নিচ হতে প্রবাহিত হয় এক বিশেষ হাওয়া, যা জান্নাতের পত্র-পল্লবে দোলা দিয়ে যায়। তখন জান্নাতের হুরেরা মুগ্ধ হয়ে তা দেখে এবং বেহেশতের দ্বাররক্ষী ফেরেশতা ‘রিদওয়ান’ কে প্রশ্ন করে, ‘রিদওয়ান, এ কোন মাস? সে বলবে, এটা মাহে রমাদ্বান, যাতে সব গোনাহ্ ক্ষমা করা হয়। ‘তখন তাঁরা ফরিয়াদ করবে, ‘হে প্রভু, এ মাসে ইবাদতকারী তোমার বান্দাদের থেকে তুমি আমাদের জুটি বানিয়ে দাও, তাঁদের দেখে আমাদের চোখ শীতল হবে, আমাদের দেখে যেন তাঁদেরও নয়ন জুড়িয়ে যায়’। মাসটি শেষ হলে আর দেখা যাবে না সাহ্রীর আয়োজন, না ইফতারের পুণ্য উৎসব। না তারাভীর জামাত। শোনা যাবে না তেলাওয়াতে কুরআনের ললিতস্বর। বিদায় হে রোযার মাস, রহমতের মাস, কুরআনের মাস। আল্বিদা হে মাহে রমাদ্বান।

লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।