‘আমৃত্যু বিপ্লবী জাঁ-লুক গোদার’

হুমাইরা তাজরিন »

প্রয়াত ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ-লুক গোদারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আয়োজিত হয় দুই দিনব্যাপী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টায় নগরীর পাঁচলাইশের অঁলিয়স ফ্রঁসেসে এ চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়।

চট্টগ্রাম ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সভাপতি শৈবাল চৌধূরীর সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন লেখক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ।

লেখক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ জানান, চট্টগ্রাম অঁলিয়স ফ্রঁসেসে তিনি ফরাসী ভাষার হাতেখড়ি নেন। তবে ১৯৭৯ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে ঢাকা গেলে ঢাকার অঁলিয়স ফ্রঁসেসে তিনি প্রথম মাসকিউলিন ফ্যামিনিন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জানতে পারেন জাঁ-লুক গোদার সর্ম্পকে।

তিনি বলেন, ‘আজকে ( ২৬ মে) যাকে নিয়ে আলোচনা তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহীরূহতুল্য। তার ঘটনাবহুল জীবন আলোচনায় আমি বিশেষ কিছু বিষয় নিয়ে বলবো। প্রথমে বলবো সত্যজিৎ রায়ের কথা। আপনারা ভাববেন, সত্যজিৎ রায়ের সাথে তার কি সম্পর্ক। দুইজন তো দুই বিপরীত মেরুর নির্মাতা। সত্যজিৎ রায় ছিলেন গোদারের একজন অনুরাগী। তিনি সেই ষাটের দশক থেকে কোলকাতায় বসে গোদারকে অনুসরণ করেছিলেন।’

গোদারকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের একটি প্রবন্ধ রচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গোদারের প্রথম ছবি ব্যু দ্য স্যুফল বা ব্রেথলেস মুক্তি পেয়েছে। তারপর যখন গোদারের দ্বিতীয় ছবি মুক্তি পায় তখন তিনি এই ছবি নিয়ে সমসাময়িক একটি পত্রিকায় বৃহৎ প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে ব্রেথলেসকে এমনভাবে তিনি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন যা এখনও প্রাসঙ্গিক। গোদারের যে জীবনবাদী নিরীক্ষা তার, সত্যজিৎ রায়ের নন্দন তাত্ত্বিক ধারা বা কলাকৈবল্যবাদ বলা যায়। দুটো পুরাপুরি ভিন্ন মেরুর। তবুও গোদারের প্রতি সত্যজিতের অনুরাগে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। ১৯৬৬ সালে ফ্রান্সে যখন ছাত্ররা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দাবি নিয়ে প্রাণপণ আন্দোলন করছে তখন গোদার তার সতীর্থদের সাথে মিলে জমকালো কান উৎসব বন্ধের উদ্যোগ নেয়। গোদারের প্রতিবাদের মুখে কান কর্তৃপক্ষ উৎসব বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী গোদারের বহু ছবি মুক্তি পেলেও একটিও কানের সর্বোচ্চ পুরস্কার অর্জন করতে পারেনি। তবে ২০১৪ সালে কানে তিনি জুরির একটি পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।’

চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারা আদি, মধ্য, অন্তের অত্যাবশ্যকীয়তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো থাকবে তবে ধারাবাহিকতা অত্যাবশ্যক না। তিনি নিজের চলচ্চিত্রেও আদি, মদ্য, অন্তের ধারাকে ভেঙে দিয়েছেন। তার চলচ্চিত্রে কখনও শেষটা এসেছে শুরুতে। শুরুটা শেষে। তিনি ১৯৬৭ সালে উইকেন্ড চলচ্চিত্রের শেষে একটা বাক্য রাখেন, সেটি ছিল দ্য এন্ড (শেষ) অব সিনেমা। এই শেষ আসলে একটি সিনেমার সমাপ্তি নয়; তিনি বুঝিয়েছেন, গতানুগতিক ধারার সিনেমার সমাপ্তিকে। তারপরই মুক্তি পায় তার নবতরঙ্গ আন্দোলনের বলিষ্ঠ উচ্চারণ নিউ ওয়েভ। তিনি রাজনীতিক সিনেমাকে রাজনৈতিকভাবেই নির্মাণ করেছেন। রাজনীতিকে গভীর থেকে দেখেছেন তিনি। ১৯৭০ সালে তিনি চলে যান প্যালেস্টাইনে। আমরা জানি, তিনি ভিয়েতনামের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালের হেয়ার এন্ড দেয়ার চলচ্চিত্রটি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কিত।

গোদারের উক্তি উদ্বৃতি করে তিনি বলেন, ‘গোদার বলেছেন, প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতা সংগ্রাম বৈশ্বিক সমাজতন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করলে আপনাকে প্যালেস্টাইনকে সমর্থন করতে হবে। তিনি আমৃত্যু বিপ্লবী ছিলেন, তাই স্বজ্ঞানে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। মৃত্যুকেও নিজের ইচ্ছায় বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় যখন স্ত্রী এনি ওয়াজেমেস্কির সাথে তার বিচ্ছেদ হয়; তখন তিনি দুই বার আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তিনি স্বেচ্চাচারিতাকে সমর্থন করেছেন এবং জীবনের শেষ মুর্হূতেও তিনি বিপ্লব করেছেন।’

প্রদর্শনীর শুরতে বক্তব্য রাখেন অঁলিয়স ফ্রঁসেসের পরিচালক ব্রুনো ল্যাক্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা জাঁ-লুক গোদারের ৪টি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। তিনি এ আয়োজনে যারা সম্পৃক্ত তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আশা করি প্রদর্শনীটি আপনাদের ভালো লাগবে।’

গোদারের ব্রেথলেস চলচ্চিত্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সৈকত দে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন গুরুপদ চক্রবর্তী।

প্রসঙ্গত, ২ দিন ব্যাপী এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর প্রথম দিন চট্টগ্রাম আঁলিয়স ফ্রঁসেস অডিটোরিয়ামে গতকাল বেলা সাড়ে ৪টায় প্রদর্শিত হয় ব্যু দ্য স্যুফল বা ব্রেথলেস এবং সন্ধ্যা ৬টায় পাইরোট লঁ ফুঁ। আজ ২৭ মে বিকেল ৪টায় প্রদর্শিত হবে আলফাভেল এবং সন্ধ্যা ৬টায় লা চিনোয়েজ।