আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস : মূলধারায় আসুক প্রতিবন্ধীরা

খন রঞ্জন রায় »

তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক মানুষ হতে কম শারীরিক সুবিধার অধিকারী ব্যক্তিদের জন্যই আজকের এই দিবস। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে যথাসম্ভব প্রয়োজনীয় মানবিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্র উন্মোচন মানসেই জাতিসংঘ কর্তৃক এই দিবসের উদ্ভব। বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর সাধারণ পরিষদে ৩ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যদিও প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির আকাক্সক্ষায় জাতিসংঘ ১৯৮২-১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী দশক ঘোষণা দিয়ে বিশ্বব্যাপী পালন করেছিল।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতা প্রদর্শন এবং তাঁদের কর্মকা-ের প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত আজকের সারাদিন। এ দিবসটি পালনের ইতিহাস পুরনো। ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক ভয়াবহ খনি দুর্ঘটনায় বহু মানুষ মারা যায়। আহত পাঁচ সহ¯্রাধিক ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। খাদ্য, কর্ম, চিকিৎসাসহ সব ক্ষেত্রে তাঁরা বঞ্চিত ছিল। তাঁদের সাহায্যে বেশকিছু সামাজিক সংগঠন এগিয়ে আসে। প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, এটা প্রমাণের জন্য কাজ করে সামাজিক সংস্থাগুলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে সারা বিশ্বে ১৫ শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে শারীরিকভাবে অক্ষম। সেই হিসাবে বিশ্বের ১০০ কোটিরও অধিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯ কোটি ৩০ লাখ প্রতিবন্ধী শিশু, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৯ শতাংশ। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চার ভাগের তিন ভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, যার মধ্যে ৪০% প্রতিবন্ধী শিশুর বসবাস আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে।
উন্নয়নশীল অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশে এখনও প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী কত তা নিয়ে এখনও পরিপূর্ণ জরিপ হয়নি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশে পুরুষ প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৯ লাখ ৮১ হাজার ৭৪১ জন এবং নারী প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৩৯ জন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ২ কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধীরা এখনও সমাজে অবহেলায় পাত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। প্রতিবন্ধীরাও এ সমাজের অংশ। তাঁদের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা কাম্য নয়। তাঁদের রয়েছে বেঁেচ থাকার সমান অধিকার।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধিকতার কারণে তাঁদের চলাফেরা ও কাজে কর্মে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার প্রয়োজন হয় প্রতিবন্ধীবান্ধব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয় নাই বলে। বেশিরভাগ অভিভাবক তাঁদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে অবহেলা দেখান। প্রতিবন্ধীদের মূলধারায় নিয়ে আসার শিক্ষার এটি একটি প্রধান অন্তরায়। পাশাপাশি দারিদ্র্যের কারণে রাস্তাঘাটে দেখা যায় প্রতিবন্ধী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে নানা অজুহাত দেখিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ায় অভিভাবক।
দেশের সব জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল¯্রােতে নিয়ে আসতে হবে। দেশের বিপুলসংখ্যক প্রতিবন্ধীকে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে টিকে থাকার উপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার। এদেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে প্রতিবন্ধীদেরও শিক্ষায়, ভাবনায়, সম্পদে সমৃদ্ধ করার আয়োজন করতে হবে। যাতে আধুনিক ও টেকসই এবং উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী মানুষেরা পিছিয়ে না পড়ে।
এছাড়াও জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়গুলো সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঝউএ এর ১৭টি লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজের মূলধারায় আনা সম্ভব হবে এবং এর মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী অপ্রতিবন্ধী মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে উঠবে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র এবং উন্নত সমাজ ব্যবস্থা। বাংলাদেশ আজ নি¤œ আয়ের দেশ হতে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন দেশের সকল মানুষের উন্নয়ন কার্যক্রমে সমানভাবে অংশগ্রহণ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী। এ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সার্বিক জাতীয় উন্নয়ন ও কল্যাণ সম্ভব নয়।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আমাদের আপনজন। তাঁদেরও সকলের ন্যায় মৌলিক চাহিদা পূরণ স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় কাউকে পেছনে ফেলে বা বাদ দিয়ে নয় এ প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার পথ খুঁজতে হবে। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে তাঁদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের মূল ¯্রােতে সম্পৃক্ত করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আরও বেগবান হবে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য তথ্যপ্রযুক্তি খেলাধূলাসহ নানা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা সফলতার স্বাক্ষর রাখছে। আমরা জানি শিক্ষাই জাতির মেরুদ- ও জ্ঞানই শক্তি। যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের দেশও এগিয়ে যাচ্ছে ডিজিটালের দিকে। প্রতিবন্ধীদেরকেও ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে হলে প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী সকলে মিলে কাজ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন নির্ঝাঞ্জ¦াটভাবে উৎরে যাবো।
তবে এজন্য প্রয়োজন, দেশের মোট জনগণের জীবন মানোন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা দূর করা। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে আত্মকর্মসংস্থান, আত্মনির্ভরতার বেলায়। শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী সন্তানদের প্রতি মা-বাবার সচেতন হওয়া জরুরি। কোনো শিক্ষিত মানুষই দেশের জন্য বোঝা নয়, বরং সম্পদ। দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধীরাও অবদান রাখতে পারে। যোগ্যতা অনুযায়ী আত্মনির্ভরশীল কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদেরও দেশের সম্পদে পরিণত করা সম্ভব।
মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে এখনো সত্তর শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। স্বভাবত বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী গ্রামবাসী। একজন প্রতিবন্ধীকে শিক্ষার আলো পেতে গেলে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
প্রতিবন্ধীদের সক্ষমতার মূল্যায়নের পর পেশাগত পথনির্দেশ দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে তৃণমূল স্তরে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোতে যুক্ত করা সময়ের দাবি। দেশের স্বার্থে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সর্বাগ্রে দরকার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া, সর্বস্তরে পুনর্বাসন, পরিষেবা, কর্মবিনিয়োগ এবং এ ধরনের মানবিককাজে পরিবেশ সৃষ্টি করে সক্ষমতাপূর্বক সুনির্দ্রষ্টিকরণ করে পণ্যভিত্তিক প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষক তৈরি করা। তবেই প্রতিবন্ধী দিবস সার্থক হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী
শযধহধৎধহলধহৎড়ু@মসধরষ.পড়স