আত্মহত্যার নতুন ভাষাশিল্প

খালেদ হামিদী

রুশবিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ বলে পরিচিত কবি ভøাদিমির মায়াকোভস্কি বিবাহিত নারী পোলানস্কায়ার সঙ্গে প্রেমের বা পরকীয়ার অভিঘাতে রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন বলেই অনেকের ধারণা। বিবাহিত কবি, যতদূর মনে পড়ে, তিন নারীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান। আত্মহননের পর মায়াকোভস্কির নোটবুকে প্রাপ্ত ‘একটা পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা’ কবিতায় তিনি ঘুমোতে যাওয়া অথবা নিদ্রিত প্রেয়সীকে অবাক চোখে জগতের সুচারু নৈঃশব্দ্য অবলোকনের আহ্বান জানান। নিজে রাতকে আকাশের বেদিতে তারার অর্ঘ্য নিবেদন করতে দেখেন এবং জানান, অমন সময়ে কেউ একজন উঠে ইতিহাস, চলিষ্ণু সময় এবং বিশ্বব্রহ্মা-ের সাথে কথা বলছে। ফ্রিডরিখ নীৎশে বলেন : ‘ঞযব ঃযড়ঁমযঃ ড়ভ ংঁরপরফব রং ধ মৎবধঃ পড়হংড়ষধঃরড়হ : নু সবধহং ড়ভ রঃ ড়হব মবঃং ঃযৎড়ঁময সধহু ধ ফধৎশ হরমযঃ.’ পার্থক্য কেবল এই, মায়াকোভস্কির রাত অত অন্ধকার নয়, তারকাখচিত, যা বাঁচার প্রেরণা যোগায়। আলবেয়ার কামুর ভাষায়, ‘ইঁঃ রহ ঃযব বহফ ড়হব হববফং সড়ৎব পড়ঁৎধমব ঃড় ষরাব ঃযধহ ঃড় শরষষ যরসংবষভ’.
নোটবইয়ে পাওয়া মায়াকোভস্কির কবিতাটা ওভাবে নিজেকে নিঃশেষিত করবার আগে রচিত নিশ্চয়। তাই এরও দুই যুগাধিক আগের ‘জ্যোৎ¯œালোকিত রাত’ কবিতায় তিনি এক টুকরো চাঁদকে সুপের পেয়ালায় তারার মাছ খুঁজে ফেরা রুপার চামচরূপে দেখতে পান। জীবন এত সুন্দর! কিন্তু আমাদের তরুণ কবি একরাম আজাদ কেন আত্মহত্যা বিষয়ে ‘একটি উসকানিমূলক কবিতা’ লেখেন ‘বাঁ পাশের শূন্য’ শীর্ষক তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে?
গদ্যকবিতাটির তৃতীয় স্তবকে কেন তিনি বলেন : ‘ধরুন আপনি মরবেন কিন্তু মরেও আপনি কিছু করতে চান, তো আত্মহত্যাকে আমি সাজেস্ট করব।’ চমৎকার বৈঠকি মেজাজে আরও যোগ করেন :‘জাস্ট ইন্টারেস্টিং সামথিং!’
এই উচ্চারণের আগে এবং পরেও তিনি মৃত্যুভয় ও রোগশোকজনিত মৃত্যুকে প্রায় কাপুরুষোচিত বলে ঘোষণা দেন, যেখানে কিনা সমগ্র মানবসমাজেই আত্মঘাতে মরণকেই মহাপাপ এবং কাপুরুষোচিত জ্ঞান করা হয়। কবির এই প্রচলবিরোধী অবস্থান নতুনত্ব প্রত্যাশী সচেতন পাঠককে টেনে রাখে। এক স্মার্টনেস সঞ্চারিত হয় পাঠকের চেতনায়। মজা মেলে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের এই অভিনতুন শ্লেষেও : ‘মরার কথা উঠলেই আমি বরাবর মৃত্যুসম্পর্কিত উইকিপিডিয়ায় ডুবে যাই। মৃত্যুর সুফল ও কুফল নিয়ে মনে মনে কুড়ি নম্বরের রচনা তৈয়ার করি। মৃত্যুর ব্যুৎপত্তি, রকমফের ও আদর্শ মৃত্যু কী এ বিষয়ক বিস্তারিত তর্কও। তর্কে ঢুকলে যেহেতু আমি সিরিয়াস হয়ে উঠি, আর মরার ফাঁক থাকে না।’
কিন্তু কেন? একরাম কি জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার প্রেরণায় আত্মহত্যাকেন্দ্রিক কোনো দার্শনিকতায় উদ্বুদ্ধ হতে চান পুনরায়? নাকি নিজের অজান্তেই এর সমান্তরালে, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের চূড়ান্ত আস্ফালনের এই সময়টায় প্রাগুক্ত শ্লেষের পরে এক প্রকার দ্ব্যর্থবোধকতায় পাঠককেও সচকিত করে তোলেন এই বলে : ‘চাইলে মরার আগে এক বোতল রাশিয়ান ভদকা অথবা কয়েক ডজন চুমোও হাতিয়ে নেবার সুযোগ থাকে।’ তবে ‘কয়েক ডজন’ চুম্বন ‘হাতিয়ে নেবার’ উল্লেখের মধ্যে প্রেম-কামবঞ্চিত পুরুষের দমিত ক্ষোভেরও যে প্রকাশ ঘটে না, তা নয়।
হুমায়ুন আজাদ তো ‘আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি’ কবিতায় আত্মহননের জন্য ধারালো ছুরি, স্লিপিং পিল, রিভলবার, মধ্যরাতের ছাদ, ভোরবেলাকার ট্রেন এবং ‘সারি সারি বৈদ্যুতিক তার’ থাকা সত্ত্বেও প্রেয়সীকেই ‘সবচেয়ে বিষাক্ত অস্ত্র প্রিয়তমা মৃত্যুর ভগিনী’ অভিহিত করেন যাকে ছুঁঁলে, দেখলে এবং এমনকি যার নাম শুনলেও তিনি নিজের ভেতর নিজেকে হত্যা করেন বলে জানান এই বলে : ‘আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি।’
লক্ষণীয়, এই অসামান্য কবিতায় আজাদের আত্মধ্বংসের স্বীকারোক্তি এক প্রকার নির্বিরোধী কিংবা নির্বিবাদী। কিন্তু আমাদের আলোচ্যমান কবি একরাম আজাদ উপর্যুক্ত ক্ষোভকে, চতুর্র্থ অনুচ্ছেদে এসে, বাক্সময় করে তোলেন বিরুদ্ধতা এবং বিদ্রোহের দার্ঢ্যে এই বলে : ‘আবার আত্মহত্যা করে আপনি করতে পারেন একটি বিপ্লবও; পরকীয়া কর্তৃত্ব কিংবা মাথামোটা ‘সিস্টেমে’ নগদে মুতে দিয়ে মরে গেলেন দ্যাট’স অসাম!’
উল্লেখ্য, এখানে মায়াকোভস্কি কিংবা হুমায়ুনের নারীপ্রেমের পরিণতি এবং জীবনানন্দের প্রাগুল্লিখিত কবিতার বিবাহিত সেই পুরুষের আত্মজীবনাবসানের কোনোটাই নেই। আত্মহত্যার পরামর্শের কারণ হিসেবে আছে ‘পরকীয়া কর্তৃত্ব’ এবং ‘মাথামোটা সিস্টেম’। এ দুয়ের মাঝখানে কবির ‘কিংবা’ শব্দটি পাঠকের চেতনায় ‘এবং’ হয়ে ওঠে। প্রথমত ক্রিয়াবাচক বিশেষণ বা বিশেষায়িত ক্রিয়ার মধ্যে নারীর, নারীপ্রেমের ভূমিকার সম্ভাবনা সুনিশ্চিত নয়। এই কর্তৃত্ব, সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায়, পরগাছা শোষক শ্রেণির বলেও ধরে নেয়া যায়। পাশাপাশি সমগ্র শোষণমূলক বা বিষম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে, যাকে ‘সিস্টেম’ বলা হয়, শুধু ‘মাথামোটা’ বলে শনাক্তকরণ অবশ্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিনিধিত্বশীল নয়। তবে এগুলোর ওপর মূত্রত্যাগ সত্যিই দারুণ। কবির স্বঘোষণা ‘অসাম’ তাই এখানে অনস্বীকার্য।
একরামের বাংলা বানানে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার মোক্ষম, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাছাড়া কথ্যবাকরীতি ও ক্রিয়াপদের প্রয়োগও আলোচ্যমান কবিতায় অনুসৃত মনে হয় না, স্বতঃস্ফূর্ত ঠেকে। যদিও, গেল শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিদের কারও কারও কবিতায় এগুলো এখনও সুলভ। এক্ষেত্রে একরামের আত্তীকরণ এবং একই সঙ্গে প্রায় নিজস্বীকরণের বিষয়টি লক্ষযোগ্য। তাঁর অব্যবহিত পূর্বজ ও সমসাময়িকদেরও কয়েকজন কবির কবিতায় এমন ভাষিকপ্রবণতা অবশ্য পরিলক্ষিত।
পঞ্চম অনুচ্ছেদে (নাকি স্তবকে? কবিতাটি অবশ্য গদ্যে লেখা), আত্মহত্যার ‘উসকানি’ বা একে মহিমান্বিতকরণের বিষয়টি আরও ত্বরান্বিত হয় এভাবে :

‘আপনি স্যুইসাইড করুন, আপনার শত্রুও চমকাবে। আর যখন চমক লাগবে, আপনি হয়ে উঠবেন টপিকস অব দ্য ডে/ উইক/ ইয়ার। এভাবে হতে পারেন কিংবদন্তিও।’

বলাবাহুল্য, এই দুশমন ঠিক শ্রেণিশত্রু নয়। কবির অভিন্ন শ্রেণির কেউ অথবা এমনকি হতে পারে বিরুদ্ধশ্রেণির সহায়কশক্তি। তবুও চমক লাগে। তাই আত্মঘাতী ব্যক্তির ‘ডে/ উইক/ ইয়ারের’ ‘টপিক’ এবং এমনকি ‘কিংবদন্তিও’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বিষয়ে প্রশ্ন আর যেন তোলাই যায় না। কিন্তু আত্মহত্যাকে বিশেষায়িতকরণের কবির যে কাব্যিক উদ্দেশ্য বা প্রতিপাদ্য তা সার্থকতা লাভ করে।
এরপর এক বাক্যের সমাপ্তিতে একরাম পুরো কবিতার সারফেস মিনিংকেই, বলা যায়, সংক্ষিপ্ত করেন : ‘বিশ্বাস করুন, আত্মহত্যায় একধরনের পৈশাচিক তৃপ্তি থাকে যা অন্য কোনো মৃত্যু আপনাকে দিতে পারে না।’ তবু তাতেও পাঠক ক্লিকড্ হয়। কিন্তু ফের প্রশ্ন : কেন? আত্মহননকে তিনি অন্য সবধরনের মৃত্যুর তুলনায় একক মহিমাদান করেন বলেই? কেবল এই কারণেই নয়। তিনি বিদ্যমান সমগ্র বিষম ব্যবস্থাকে, স্বাভাবিক কথা বলার ঢঙে, অথচ তীব্র্রভাবে, পরিহাস বা কটাক্ষ করতে সক্ষম হন বলেও। কিন্তু ‘পৈশাচিক তৃপ্তি’ কেন? নানাদিকে নারীনিগ্রহ ও নরহত্যার পাশবিক মাত্রাবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় একি কবির ক্ষোভপ্রসূত ব্যঙ্গাত্মক উচ্চারণ নয়? হ্যাঁ, তা-ই তো। অন্য অনেক মৃত্যু পরাজয়ের, যে করে সে মরে ধরনের। কিন্তু আত্মহত্যা অসম সাহসের বিষয় বলেও তা মারাত্মক প্রতিবাদেরও উদাহরণ। সমস্ত প্রকার শোষণ, উলঙ্গ ও ছদ্মবেশী নিপীড়নের বিরুদ্ধে, এবং একই সঙ্গে বিপরীতে, এ এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্নও বটে। যদিও, তা কবিকথিত ‘বিপ্লব’ নয়। বিষম সমাজে, যেখানে অধিকাংশ মানুষই প্রচলিত ব্যবস্থার অধীন, সেখানে কেউ যেমন একা স্বাধীন হতে পারে না তেমনি একাকী ঘটাতে পারে না বিপ্লবও। বিদ্রোহ একক হতে পারে, কিন্তু, বলাবাহুল্য, বিপ্লব সামষ্টিক।
আরেকটা কথা, আত্মহননকে পরাজয়ও বলা হয়। তাছাড়া কামু যে বলেন নিজেকে মারার চেয়ে বাঁচার জন্যে অধিকতর সাহসের প্রয়োজন, তাও ভুলে যাওয়ার নয়। আমাদের দেশে অবশ্য আত্মহত্যা বিরল ঘটনা। হারাকিরি (কোনো ব্যর্থতা বা পরাজয়ের দরুন পেট চিরে যে আত্মহত্যা) জাপানিদের ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার প্রায়। বর্তমানে তাদের কেউ কেউ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েও নিজেকে শেষ করে। প্রাণিকুলে তিমি, ডলফিন, লেমিং ছাড়াও কিছু পাখিও (ঠোঁটে ঠুকরে ঠুকরে নিজেদের সব পালক উপড়ে) আত্মহত্যা করে। পুরুষ তিমির মৃত্যুতে এর সঙ্গিনীও আত্মহননে মাতে বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে ভালোবাসার অংশীদারের প্রশ্নে মানুষের সাথে এই প্রায়-মিল কিছুটা বিস্ময়কর বটে। কিন্তু মানব-মানবীর আত্মঘাতের হেতু, বলাবাহুল্য, ঢের ভিন্নতর। পুনরায় উল্লেখ্য যে, একরাম আজাদের এই কবিতা বিষম প্রেমের পরিণতি কিংবা কোনো বিফলতা-পরাজয়ের ইঙ্গিত আমাদের দেয় না। বরং এই উপলব্ধিই পাঠকমানসে কেলাসিত করে যে মানুষের আত্মহত্যা এই ধনবাদী অমানবিক সমাজ-সভ্যতারই পরাজয় এবং এর অসম্পূর্ণতার ফল, এমনকি স্মারকও, যা সমগ্র ব্যবস্থার প্রতি বিরাট এক জিজ্ঞাসাচিহ্ন হয়ে আমাদের একই সঙ্গে বিদ্ধ ও আন্দোলিত করে।