অপরাধ প্রবণতা : দায় ও প্রতিকার

অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ  »

দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের সকলেরই উচিত দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আইন মেনে চলা। অপ্রিয় সত্য যে, আইন-আদালত থাকলেও আইনের শাসন মানার সংস্কৃতি পুরোপুরি গড়ে উঠেনি। আইন না মানার কারণে বাড়ছে সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা। সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। কেউ যদি আইন মেনে না চলেন বা আইন ভঙ্গ করেন কিংবা আইন ভঙ্গের হুকুম দেন তখন সমাজের, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর সে আইন যদি দেশের কোনো জনপ্রতিনিধি বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন ব্যক্তি ভঙ্গ করেন বা আইন ভঙ্গের হুকুম দেন তাহলে তা জনগণের মাঝে আরো নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হত্যাকা- ও অন্যান্য অপরাধের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মাত্রা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কেন মানুষ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে? খুঁজছি সে প্রশ্নের উত্তর। শিক্ষিত- অশিক্ষিত সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই এটি দেখা যায়। আইন অমান্য করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে একদিনে গড়ে উঠেনি বরং দীর্ঘদিন ধরে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।  নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অপরাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ ও দুর্নীতির প্রতি আসক্তির ফলে মানুষ পরিণত হতে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক মানুষে। এসব কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থির অবনতি ঘটেছে। কোন ব্যক্তি একবার যদি অপরাধ করে তার শাস্তি থেকে কোনমতে পার পেয়ে যায় পরবর্তীতে উক্ত ব্যক্তি পুনরায় অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না।

আবার পরিবারের কেউ যদি অপরাধের সাথে জড়িত থাকে জিনগতভাবে তার পরবর্তী প্রজন্মের ওপর তার প্রভাব পড়তে পারে।

আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ করা হয় থানাসমূহে। আবার যে ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ গ্রহণ করতে পারে না সেক্ষেত্রে কোর্টে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে থানায় এজাহার দায়েরের মাধ্যমে ফৌজদারি মামলার সূত্রপাত ঘটে এবং থানা পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আদালতে মামলাসমূহের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই, ফৌজদারি মামলার মূল ভিত্তি এজাহার দুর্বল হলে, মামলার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দূর্বল এজাহারের বা বস্তুগত তথ্যবিভ্রাটের কারণে ফাইনাল রিপোর্টের মাধ্যমে মামলার অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে। এছাড়াও, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের অভাবের কারণে মামলার চার্জসিটে প্রকৃত ঘটনা প্রতিফলিত হয় না যা মামলার বিচার পর্যায়ে ফাঁক ফোকর গলে আসামির পার পেয়ে যাওয়ার পথ করে দেয়।

প্রকৃত অপরাধের ক্ষেত্রে মামলার এজাহার গ্রহণ ও তদন্তপূর্বক চার্জসিট প্রদানে থানা পুলিশের দক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর শুরু হয় মূল বিচারকার্য। এই অবস্থায় প্রকৃত ভিকটিমকে ন্যায়বিচার প্রদানের মূল দায়িত্ব বিচারক ও আইনজীবীদের ওপর এসে যায়। বিশেষ করে, ভিকটিম পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ও কোর্ট পুলিশের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরাধীকে দন্ড প্রদানে সহজ হয়। অথচ, বাস্তবে প্রসিকিউশন পক্ষের দুর্বলতার কারণে ফৌজদারি মামলার আসামিরা অনেক ক্ষেত্রে খালাস পেয়ে যায়। আবার, মামলার সাক্ষীদের স্বাক্ষ্য প্রদানে অনীহা ভিকটিমের ন্যায়বিচার লাভে অন্যতম অন্তরায় এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্যের অভাবে অপরাধী খালাস পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে, বিচারক ও আইনজীবীর কিছুই করার থাকে না। কেননা তাদেরকে নির্ভর করতে হয় সাক্ষ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর।

যারা আইন মানতে চান না, নিজের সুখ-সুবিধাকে বড় করে দেখেন, প্রয়োজনে অন্যকে মেরে ধরে নিজের ইচ্ছেকে পূরণ করতে চান অন্যায়ভাবে, তাদের জন্যই তৈরি হয় আইন-আদালত বা বিচারব্যবস্থা। বিচারব্যবস্থা হচ্ছে সভ্যতার অবদান। আইন অমান্য করা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে সকলেরই বেরিয়ে আসতে হবে। আইন দেশের শৃঙ্খলা রক্ষা করা ও অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ়করণের চালিকাশক্তি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারহীনতা যেমন অগ্রহণযোগ্য, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতাও অনুরূপভাবে অগ্রহণযোগ্য। কোনো অপরাধীকে অপরাধ সংঘটনের দায়ে গ্রেপ্তার ও বিচারে সাজাপ্রাপ্ত হতে দেখলে অনুরূপ  ব্যক্তিরা সতর্কতা অবলম্বন করে অপরাধ করা ও তজ্জন্য সাজা ভোগ থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে সচেষ্ট থাকবে। প্রতিটি নাগরিকের মনে, বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির মনে এমন ভীতি জন্মাতে হয় যে অপরাধ করে কোনো ভাবেই ছাড় পাওয়া যাবে না, বিচারের আওতায় আসতেই হবে। সমাজে কে কোথায় কোনো অপরাধমূলক কাজের গোপন পরিকল্পনা ও তৎপরতায় লিপ্ত গোয়েন্দা বাহিনীকে তা উদঘাটনে সচেষ্ট থাকতে হবে।

অপরাধ সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে আইন সহায়তাকারী বাহিনী হিসেবে পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। পুলিশ কথাটির অর্থ সাহায্যকারী। সমাজে নিরীহ জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে পরিচিত পুলিশের হাতে ন্যস্ত। পুলিশ তৎপর হলে অপরাধী চক্র সতর্কতা অবলম্বন করে সাবধান হয়।

কিন্তু পুলিশ যদি অবহেলার সাথে দায়িত্ব পালন করে কিংবা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তবে অপরাধ দমন তো দূরের কথা, তা আরও বিস্তার লাভ করে। তদন্তের লক্ষ্যে বের করে আনতে হবে অপরাধ সংঘটনের পেছনের কারণ, অপরাধের পরিকল্পনা এবং কে ও কারা এর সঙ্গে জড়িত এবং তাদের বর্তমান অবস্থান। অপরাধ ঘটার পর সংক্ষিপ্ততম সময়ে সফল তদন্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করে আদালতে চার্জসিট দেয়া তদন্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।

অপরাধের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। জনপ্রতিনিধি হিসাবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে যাতে তারা অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেয়। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। আদালতে সাক্ষ্যদানের প্রয়োজন হলে সাক্ষ্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাক্ষ্যের অভাবে অনেক অপরাধী খালাস পেয়ে যাচ্ছে। সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সাক্ষীরা স্বঃতস্ফূর্তভাবে সাক্ষ্য প্রদানে এগিয়ে এলে ন্যায় বিচার নিশ্চিতি অনেক সহজ হয়ে যায়। অপরাধপ্রবণতা রোধে রাষ্ট্রকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলে অনেকেই অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। পরিশেষে বলব- সর্বত্র আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের সকলেরই উচিত দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা। এতে আমাদের সকলেরই মঙ্গল।

 

লেখক : আইনজীবী