অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামছেই না!

রূপগঞ্জ ট্যাজেডি

মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী »

বাংলাদেশ বৈশ্বিক মহামারি বা অতিমারি তথা করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ভয়াবহ দুর্যোগ ও ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দিনে দুই শতাধিকের ওপর মানুষের মৃত্যু এবং দশ হাজার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির রেকর্ড পার করছে। পাশাপাশি দেশে ভয়াবহ অগ্নিকা- এবং তাতে মানুষের মর্মান্তিক, মর্মন্তুদ, হৃদয়বিদারক, মৃত্যুর ঘটনা কোনোমতেই যেন থামছে না। গত ৮ জুলাই’২১ বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় আগুন লাগে। “ছয়তলা বিশাল কারখানা ভবন থেকে বের হওয়ার পথ (সিঁড়ি) মাত্র দুটি। এর মধ্যে ভবনের সামনের পথটি ব্যবহারের উপায় ছিল না। কারণ, আগুন এদিক থেকেই ছড়িয়েছে। ভবনের পেছনের দিকের পথ দিয়েও কেউ বের হতে পারছিলেন না তীব্র তাপ ও ধোঁয়ার কারণে। ফলে শ্রমিকেরা ছুটতে থাকেন ছাদের দিকে। কিন্তু সবাই ছাদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। এর আগেই মৃত্যু এসে হাজির হয়েছে”। ( সূত্রঃ প্র/আলো, ১০ জুলাই’ ২১)। ওই দিনই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে ৩ জন মারা যান। সব মিলিয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৫২ জন নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।
আগুনে পুড়ে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাঁরা সবাই বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় কাজে আসেন। শ্রমিকদের ছুটি হওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ৬টায়। ছুটির আনুমানিক ত্রিশ মিনিট আগে বিকেল সাড়ে ৫টার পর ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। আগুন লাগার পর মুহূর্তের মধ্যে প্রচ- ধোঁয়া তৈরি হয় এবং তা দ্বিতীয় তলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শী ও কারখানার আহত শ্রমিক সবুজ আলমের বরাতে জানা যায়, তিনি কাজ করছিলেন দ্বিতীয় তলায়। হঠাৎ ভবনের ভেতর ধোঁয়ার কু-লী দেখতে পান। তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রথম ভবনের সামনের সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। পরে দৌড়ে পেছন দিকের সিঁড়ি দিয়ে ধোঁয়ার মধ্যেই নেমে আসতে সক্ষম হন। আগুনের সূত্রপাত যখন হয়, তখন কারখানায় প্রায় ১৮০ জন শ্রমিক কাজে ছিলেন বলে জানা যায়। সেদিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট টানা প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর পরের দিন ( ৯ জুলাই’২১) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়।
অতীব দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের কারখানা হাসপাতাল, মার্কেট শপিং মল, স্কুল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। অনেকক্ষেত্রে থাকলেও তা অকার্যকর থাকে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে দুর্যোগকালে তা কোনো কাজেই আসে না। এক সূত্র থেকে জানা যায়, সেদিন কারখানা ভবনে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ভবনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা তাঁদের চোখে পড়েনি। ছয়তলার এত বড় ভবনের মাত্র দুটি সিঁড়ি, তা-ও প্রশস্ত নয়। ভবনে যদি অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ভালো থাকত, তাহলে এত প্রাণহানি ঘটার কথা নয়। ভবনের আয়তন অনুযায়ী চার থেকে পাঁচটি সিঁড়ি থাকার দরকার ছিল। আগুনের তাপ ও প্রচ- ধোঁয়ায় আটকে পড়া শ্রমিকেরা মারা গেছেন। অপরদিকে হাসেম ফুডের প্রকৌশলী সালাহউদ্দিন দাবি করেন, ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। সবই আগুনে পুড়ে গেছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, ‘পুরো ভবন ঘুরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কিন্তু আমরা খুঁজে পাইনি। এটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সকলের অগ্নিনির্বাপণ বন্ধে আন্তরিকতার অভাব এবং চরম ব্যর্থতা ও অবহেলার উদাহরণ। তারা মুনাফা করতে পারেন কিন্তু শ্রমিকদের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। যেন গরীব অসহায় দুঃখী শ্রমিকদের জীবনের কোনো মূল্যই নেই।
আমাদের দেশে অগ্নিকা-, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, সড়ক দুর্ঘটনা সহ বিভিন্ন মর্মান্তিক, দুঃখজনক, অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। আর এসব নিয়ে সারা দেশে কয়েক মাস তোলপাড় চলে। কিছুদিন পরে আরেকটি ঘটনা ঘটার পরে আমরা আগের সব ঘটনা ভুলে যাই। এবং নতুন ঘটনা নিয়ে সবাই আবার হৈ চৈ শুরু করে দেই। এর আগে গত ০৪ সেপ্টেম্বর’ ২০ তারিখে নারায়ণগঞ্জ শহরের তল্লা এলাকায় মসজিদে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হন। গত ২৭ জুন’২০২১ ঢাকার মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু ঘটে এবং আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। পুলিশের ধারণা, ঘটনাটি জমে থাকা গ্যাস থেকে ঘটেছে। ভবনের নিচতলাটি একেবারে ল-ভ- হয়ে যায়৷ আশপাশের ভবনগুলো কেঁপে উঠে এবং অনেক দোকানঘরে আগুন লেগে যায়।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বিগত ২০ ফেব্রুয়ারি’১৯ তারিখে ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক। অগ্নিকা-ের কথা৷ সে রাতে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত। ওই আগুনে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনসহ ৫টি ভবন পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়৷ আর আগুনে ৭১ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন অনেকে৷ আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, ‘‘ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ রাখতেন। মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসা ভাড়া দেন। আর ওই দাহ্য পদার্থ থেকেই আগুন লাগে৷অন্যদিকে গত ২৮ মার্চ’ ১৯ তারিখে দুপুর ১টায় ঢাকার বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে (ফারুক রূপায়ণ টাওয়ার) অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ২২ তলা এভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় ও ক্রমেই সেটি অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকা-ে ২৭ জনের মৃত্যু হয় এবং ৭০ জন আহত হন।
এক তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে শিল্প-কারখানা ও আবাসিক ভবনে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকা-ে সম্পদহানি হয়েছে ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ টাকার। আর ১৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে দেশের শিল্প-কারখানায় আগুনের ঘটনা কিছুটা কমে এলেও আবাসিক ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা বাড়ছে। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর অগ্নিকা-ে ১২৪ জন নিহত হয়েছিল। বিগত ২৪ নভেম্বর’ ২০১২ তারিখে আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১১১ জন নিহত হয়। তাতে সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোশাক শ্রমিক।
রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে মাঝেমধ্যেই ঘটছে ভয়াবহ অগ্নিকা-। আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হচ্ছে নিম্নবিত্ত হাজার হাজার পরিবার। সহায়সম্বল ও মাথাগোঁজার শেষ আশ্রয়স্থল হারিয়ে পথে বসছে তারা। একই বস্তিতে একাধিকবার আগুন লাগায় অনেকে পথের ভিখারিও হচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে অন্তত ৫টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গত ৪ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিং সোসাইটি এলাকার বস্তি, ২১ ফেব্রুয়ারি মানিকনগরের কুমিল্লাপট্টি বস্তি, ১১ মার্চ কলাবাগানের কাঁঠালবাগান বস্তি, ২১ এপ্রিল তুরাগের বালুরমাঠ বস্তি এবং সর্বশেষ গত ৭ জুন রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ২০২০ সালে রাজধানীর বস্তিতে ৪১টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে, ২০১৯ সালে ২৮টি, ২০১৮ সালে ৩৩টি, ২০১৭ সালে ৮টি ও ২০১৬ সালে ২৭টি আগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এসব আগুনে হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মূলত বস্তিবাসীর অসাবধানতাই আগুনের প্রধান কারণ। পাশাপাশি বস্তির বেশিরভাগ বিদ্যুতের তার খুবই নিম্নমানের। এর ওপর যাচ্ছেতাই ব্যবহার করে। বিড়ি সিগারেটের আগুন থেকেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
অনবধানতা বা অসাবধানতা ও অসতর্কতার পাশাপাশি যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা,দুর্ঘটনার সময় নির্গমনের জন্য জরুরি ও প্রশস্ত সিঁড়ি না রাখা, সিঁড়ি বা চলাচলের পথে স্তূপীকৃত বিভিন্ন মালামাল রেখে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি, অনুমোদিত নকশা বহির্ভূতভাবে স্থাপনা নির্মাণ,বিদ্যুতের শর্টসার্কিট , গ্যাস বিস্ফোরণ, দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউন, রান্নাঘরসহ ছোটখাটো কারণে ঘটে যাচ্ছে বড় দুর্ঘটনা মহামানবিক বিপর্যয়। প্রতি বছরই অগ্নিকা-ের ঘটনায় অসংখ্য মানুষ হতাহত এবং সম্পদহানি হচ্ছে। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয় এবং তদন্ত প্রতিবেদনে অগ্নিকা-ের কারণ উল্লেখ করাসহ সতর্কতার জন্য নানা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এসব সুপারিশমালা খুব কমই বাস্তবায়ন হয়। ফলে দেশজুড়েই বাড়ছে অগ্নিকা-ের ঝুঁকি।
আমাদের দেশে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। যে ক্ষেত্রে আগুন নেভানো, মানুষকে সরিয়ে নেয়া এবং জরুরি উদ্ধার কার্য পরিচালনা করা দরকার, সেই সব ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো প্রস্তুতি নেওয়া সময়ের দাবি। সরকারি সংস্থা তথা তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মনীতি যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে কিনা তা জনস্বার্থে আন্তরিকভাবে এবং নিয়মিত তদারকি করতে হবে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা উন্নত এবং যুগোপযোগী করার পাশাপাশি অগ্নিকা-ে দায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তির ব্যবস্থা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অন্যথায় বিচারহীনতার কারণে দেশে নিয়মিত অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা মর্মান্তিক অগ্নিকা-ে মানুষের অমুল্য জীবন রক্ষা এবং সম্পদহানি বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। মনে রাখা দরকার, অযতœ অবহেলায় মানুষকে পুড়িয়ে অঙ্গার বানানোর অধিকার কোনো ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্র Ñসংবিধান দেয়নি।
লেখক : প্রাবন্ধিক