৬ জেলাকে বিশেষ প্রস্তুতির নির্দেশ । প্রচুর বৃষ্টিপাতের আভাস । ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা । চট্টগ্রাম বন্দরে অ্যালার্ট-৩ জারি
সুপ্রভাত ডেস্ক »
পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিমমধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি আরো ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় বঙ্গোপসাগরের গভীর নিম্পটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবীর। সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা এসকাপের তালিকা অনুযায়ী এ অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেমাল’; এটা ওমানের দেওয়া নাম।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই উত্তাল থাকায় মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ার সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
রাত ৮টায় বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি রাত ৮টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৪০৫ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।
চট্টগ্রাম বন্দরে অ্যালার্ট-৩ জারি
ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট ৩ জারি করা হয়েছে।তিনটি কনট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
এর ফলে জেটিতে থাকা সব জাহাজের লোড আনলোড কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।জেটির বড় জাহাজগুলোকে ডাবল ইঞ্জিন চালু রাখা সহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে আগামী জোয়ারে। ক্রেনসহ সব হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট প্যাক করা হচ্ছে যাতে বাতাসে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বন্দর থেকে ডেলিভারি কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বন্ধ করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের সতর্ক সংকেতের ভিত্তিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর চ্যানেল, জাহাজ, জেটি, ইয়ার্ড, শেড, হ্যান্ডলিং ইক্ইুপমেন্ট নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক।
ছয় জেলায় বিশেষ প্রস্তুতি
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি মোকাবিলায় সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা এই ছয়টি জেলায় বিশেষ প্রস্তুতির নির্দেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান।
তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে স্থানীয় প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ রোববার নাগাদ সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে স্থলভাগ অতিক্রম করতে পারে। এজন্য শনিবার মধ্যরাতে মহাবিপদ সংকেত জারি হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমরা বুঝতে পেরেছি, ঘূর্ণিঝড়টি আসন্ন।’
১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রেখেছি। সার্বিক প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিয়েছি।’
মহিববুর রহমান বলেন,‘ঘূর্ণিঝড়টিতে সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত কমবেশি এফেকটেড (আক্রান্ত) হতে পারে। ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে। এজন্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস হতে পারে।’
রোববার সন্ধ্যা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে আঘাত হানতে পারে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘উপকূলীয় জেলায় আমাদের প্রায় ৪ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এগুলো আমরা প্রস্তুত রেখেছি। খাদ্যের জন্য আমাদের প্রত্যেকটি জেলায় গুদামে পর্যাপ্ত শুকনো খাবারসহ যেসব জিনিস দরকার হবে এগুলো মজুত রেখেছি। প্রয়োজনে ঢাকা থেকে যাতে আরও সাপ্লাই (সরবরাহ) দিতে পারি এজন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নি¤œচাপটি শনিবারে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে। এরপর রোববার মধ্যরাতের দিকে এটি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে বলে আভাস দিচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। খবর বিবিসি বাংলা।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে রোববার মধ্যরাত। কিন্তু অনেক সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতি বেড়ে যেতে পারে, অনেক দ্রুততার সাথে সে উপকূলের দিকে আসতে পারে। এ ধরনের বেশ কিছু বিষয় আছে।’
এই গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার পর এর নাম হবে ‘রেমাল’। রেমাল একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ-বালি। এটি ওমানের দেয়া নাম।
তবে, রেমাল নামে আফগানিস্তানে একটি শহর আছে। সেই শহরের নামানুসারেই এটির নামকরণ করা হয়েছে বলে এর আগে জানিয়েছিলেন ফারুক। সেক্ষেত্রে, এই ঘূর্ণিঝড়টি সর্বপ্রথম যেখানে আঘাত হানবে, সেখানের বাতাসের গতিবেশ ঘণ্টায় ১২০-১৩০ কিলোমিটার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যখন সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা ২৬ দশমিক পাঁচ বা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে, তখন ঘূর্ণিঝড়ের পরিবেশ তৈরি হয়।
এখন, যদি কোনও নিম্নচাপ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে, তখন সেটাকে আঞ্চলিক ঝড় বলে মনে করা হয়।
কিন্তু সেটি যদি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১৯ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করে, তখন সেটিকে সিভিয়ার সাইক্লোন বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়।
বাতাসের গতিবেগ যদি এর থেকেও বেশি হয়, তখন তা ‘ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন’ বা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। এর পরের ধাপ হল সুপার সাইক্লোন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে আঘাত হানা সর্বশেষ সুপার সাইক্লোন ছিল ২০০৭ সালের সিডর (চোখ)। এটির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। তখন ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিলো।
রেমাল-এর গতিবেগ সম্বন্ধে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, ‘সিডরের মতো অত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় না এটি, ঘূর্ণিঝড় রেমাল সিডরের থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল।’
কোথায় আঘাত হানবে?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্তমানে যেই অবস্থান দেখাচ্ছে তাতে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি বাংলাদেশের ওপর দিয়েই অতিক্রম করার সম্ভাবনা আছে।
তবে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা এবং বরিশালের পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলায় রেমাল-এর আঘাত হানার সম্ভাবনা বেশি বলে জানান ফারুক।
বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাস
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ‘মনসুন’ (বর্ষা মৌসুম) শুরুর ঠিক আগে আগে আর্দ্রতা অনেক বেশি থাকে। ফলে এই সময় কোনও ঘূর্ণিঝড় দেখা দিলে তার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেশি হয় এবং বায়ুতাড়িত জ্বলোচ্ছাস সৃষ্টি হয়।
কিন্তু এবার সেই সম্ভাবনা আরও বেশি। কারণ ‘পূর্ণিমার সময় জোয়ার বেশি থাকে।’
‘এটি যদি জোয়ারের সময়ে আঘাত হানে, তাহলে জলোচ্ছ্বাস বেশি হবে। আর যেহেতু এটি ‘সিভিয়ার সাইক্লোন’ আকারে আঘাত করার সম্ভাবনা আছে, তাই বৃষ্টির পরিমাণও বেশি থাকবে,’ বলেন আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক।
আবহাওয়া অফিস ইতোমধ্যে তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, রোববার সকালে দেশের সকল বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
তবে রেমাল-এর ফলে কতটুকু উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে জানতে চাইলে ফারুক জানান, ‘রেমাল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় না, প্রবল ঘূর্ণিঝড়। আর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাধারণত তিন থেকে সাত ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়ে থাকে।’
গতিপথ বদলে যেতে পারে?
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েকদিন ধরেই ভ্যাপসা গরম পড়েছে। আর এই ভ্যাপসা গরম অনুভূত হওয়ার সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সম্পর্ক আছে।
আবহাওবিদ ওমর ফারুক জানান, যখন বঙ্গোপসাগরে কোনও ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন স্থলভাগের সব মেঘ ঘূর্ণিঝড়ের আশেপাশে চলে যায়।
‘কোনও স্থান মেঘমালা শূন্য হয়ে গেলে ভ্যাপসা গরম লাগে। এক্ষেত্রে যেদিকে ভ্যাপসা গরম লাগে, ঘূর্ণিঝড়টির সেদিকে যাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে ভ্যাপসা গরম থাকে, সেখানে ধরে নিতে হবে যে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে গেলে সেখানে বায়ুরচাপ কমে যায়। এবং, বায়ুরচাপ কমে গেলে- যেদিকে বাতাসের চাপ কমে যাবে, ঘূর্ণিঝড়টি সেদিকে যায়। ভ্যাপসা গরম আসলে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ব লক্ষণ।’
বাংলাদেশের কিছু কিছু স্থানের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাপপ্রবাহের সাথে সাথে ‘বেশিরভাগ জায়গায়ই এখন অস্বাভাবিক গরম আছে। এ কারণে ঘূর্ণিঝড়ের ‘মুভমেন্ট’ বাংলাদেশের দিকে হতে পারে বলে ধারণা করা যায়।’ তবে পরিস্থিতি বদলালে ঘূর্ণিঝড় রেমাল-এর ‘মুভমেন্ট’-এও বদল আসতে পারে।
এর কারণ, বাংলাদেশে এখন যেরকম ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকেও একইরকম গরম আছে।
এখন বায়ুর চাপ যদি বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে বেশি কমে যায়, তাহলে ঘূর্ণিঝড় তার গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলতে পারে,’তিনি যোগ করেন।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় হতে হলে প্রথমে সাগরে লঘু চাপ তৈরি হয়। প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ যখন ১৭ কিলোমিটার থাকে এবং বায়ুর চাপ কম থাকে তখন একে লঘু চাপ বলা হয়।
বাতাসে যদি ঘুর্নন তৈরি হয়, অর্থাৎ ঘূর্ণিবায়ুর আবর্তন তৈরি হলে সেখানে বায়ুর চাপ কমে যায়। কারণ আশেপাশে থেকে জলীয় বাষ্প আসে। জলীয় বাষ্প আসলে বায়ুর চাপ কমে যায়।এরপরের ধাপে রয়েছে সুস্পষ্ট লঘুচাপ।
এর আগে আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, লঘুচাপ শক্তির মাত্রা অর্জন করে ৩১ থেকে ৪০ কিমি প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের বেগ থাকলে একে সুস্পষ্ট লঘুচাপ বলা হয়। অর্থাৎ লঘুচাপ আরো শক্তিমাত্রা অর্জন করে সুস্পষ্ট লঘুচাপে রূপ নেয়। তৃতীয় ধাপে রয়েছে সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হওয়া।
মল্লিক বলেন, সুস্পষ্ট লঘুচাপ আরো শক্তিমাত্রা অর্জন করে তৈরি হয় নিম্নচাপ। এরপর নিম্নচাপ আরো শক্তিমাত্রা অর্জন করে তৈরি হয় গভীর নি¤œচাপ।’
পরে এটা সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। তবে এই আবহাওয়াবিদ বলছেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রাথমিক ধাপই হচ্ছে সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হওয়া।