২০২০ : কেবল কোভিডের নয়, বিজ্ঞানেরও বছর

নাদিম মাহমুদ »

একবিংশ শতাব্দীর নানা দিক থেকে তাৎপর্যময় বছর হিসেবে ২০২০ সালকে আমাদের প্রজন্ম বেশ ভাল করে মনে রাখবে। মহামারির বিষে বিষাদময় বছরটি ইতিহাসের পাতায় থাকবে প্রাণসংহারী পরিচয়ে। প্রকৃতির সাথে অনবরত যুদ্ধে মানবসভ্যতার এ চলাকে থমকে দেওয়া কোভিড-১৯ সংক্রমণ আমাদের করেছে শক্তিশালী। অভিযোজন ক্ষমতার বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ অন্যান্য প্রাণি হলেও কেবল কোভিড-১৯ সংক্রমণে অ্যাডাপটেশন বেশ বেদনাদায়ক। বছর জুড়ে দেশে দেশে মানুষ মরার মিছিল যখন সমগ্র জাতির রাষ্ট্র প্রধানদের ভাবিয়ে তুলছে, মানবজাতির এ দুর্দিনে ত্রাতা হিসেবে বরাবরের মত এগিয়ে এসেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীদের সীমাহীন প্রচেষ্টায় কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের কৌশল উদ্ভাবনের এ সম্মুখ যুদ্ধে শতশত গবেষক নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় মহামারি এসেছে, ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। বছরের পর বছর ধরে এই প্রাণ সংহার চললেও বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনে সংক্রমণের দফারফা হয়েছে। সেটাও ছিল সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
চীনের উহানে সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যে চীনের সাংহাই পাবলিক হেলথ ক্লিনিকাল সেন্টার ও স্কুল অব পাবলিক হেলথ, হুয়াজং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ওহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের কেন্দ্র, চীনের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সহযোগিতায় এই ভাইরাসটির জীবন রহস্য উন্মোচন করা হয় (সূত্র-২)। ১১ জানুয়ারি প্রকাশিত এ ডেটায় প্রায় ৩০ হাজার নিউক্লিওটাইডের এই সিকোয়েন্স পাওয়ার পর সারা বিশ্বের গবেষকরা তা নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করে। জানুয়ারি মাসের মধ্যে প্রায় ৫৪টি গবেষণাপত্র চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট, নেচার, সায়েন্স, বায়োকার্ভ এর জার্নালগুলোতে প্রকাশ হতে থাকে।
প্রথম দিকে গবেষণায় ভাইরাসটিকে এনকভ-২০১৯ বলা হলেও, পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নামকরণ করে ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস টু’ বা সংক্ষেপে সার্স-কোভ-২ নামে ।
এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য ও নানান দিক আলোচনা করা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা সাময়িকী দ্য নিউ ইংল্যা- জার্নাল অব মেডিসিনে- অ ঘড়াবষ ঈড়ৎড়হধারৎঁং ভৎড়স চধঃরবহঃং রিঃয চহবঁসড়হরধ রহ ঈযরহধ, ২০১৯ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে। (সূত্র-৩) করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও সংক্রমণের বিশদ আলোচনা উঠে আসে এ গবেষণাপত্রটি থেকে।
বিজ্ঞানীরা খুঁজতে থাকলেন করোনাভাইরাসের কোন প্রজাতির সাথে এর সংক্রমণ বৈশিষ্ট্য মিল পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল এটি করোনাভিরিডি পরিবারের করোনাভিরিনে গোত্রের অন্তর্গত। আলফা, বেটা, গামা ও ডেল্টা করোনাভাইরাসের মধ্যে আলফাকরোনাভাইরাস এবং বিটাকরোনাভাইরাসগুলি কেবল স্তন্যপায়ীকে সংক্রামিত করে আর গ্যামাকরোনাভাইরাস এবং ডেল্টাকরোনাভাইরাস কেবল পাখিকে সংক্রামিত করতে পারে।
এরপর গবেষকরা দেখতে পেলেন, নতুন এ ভাইরাসটি কোন প্রাণি থেকে কোন প্রাণীতে ছড়াচ্ছে এবং ঠিক কোন মেকানিজম মেনে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে তা নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।
করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি সংক্রমণশীল অংশ রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো স্পাইক প্রোটিন, যা মানবদেহের চামড়ার নিচে থাকা ধহমরড়ঃবহংরহ-পড়হাবৎঃরহম বহুুসব ২ (অঈঊ২) গ্রাহকের উপর লেগে থাকে। এবং স্পাইক প্রোটিনটি শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। ঠিক এই তথ্যটি পাওয়া গিয়েছিল জার্মানির গজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকদের কাছ থেকে এ তথ্যটি ওষুধ ও ভ্যাকসিন তৈরি করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা ভাইরাসটির ইলেকট্রন মাইক্রোসকপির ছবি ওএসিই২ রিসেপ্টরের তৃতীয়মাত্রার চিত্র পেয়ে যায়। স্পাইক প্রোটিনের ঠিক কোন অংশ অর্থাৎ ডিএনএ সিকোয়েন্সের নিউক্লিওটাইডগুলো আঁকড়ে ধরছে তার বিশদ তথ্য আমরা বেশ কিছু গবেষণায় পেয়ে গিয়েছিলাম। যেগুলো পরবর্তী গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ঠিক এ তথ্যগুলো পাওয়ার পর সারা বিশ্ব থেকে ২৩৩টি ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণা শুরু হয় (সূত্র-৫)। যার মধ্যে ৬১ টি ক্লিনিক্যাল ফেইজ ২/৩ রয়েছে।
সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গবেষকদের একদল ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে, একদল মৌলিক গবেষণায় আর একদল কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের চিকিৎসার জন্য কোন ওষুধ কাজে লাগবে তা নিয়ে এখনো নিরলস গবেষণা করছে। তবে গবেষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় বছর শেষে আমরা পেয়েছি ভ্যাকসিন কার্যকরের সুখবর দিয়েছে জার্মানির বায়োনটেক ও যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ভ্যাকসিন। সাথে যোগ হয়েছে মডার্নার ভ্যাকসিন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার গবেষকদের তৈরি করা ভ্যাকসিনের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক নিয়ে সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে কথা হলেও, দিন শেষে তারাও কিছুটা সফলতার স্বাদ পাচ্ছে।
সব মিলিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে গবেষণায়। মূলত রিসার্চারদের মানব হৈতিষী মনোভাবের কারণে, পৃথিবীর ইতিহাসে দ্রুততম সময়ে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের বিপরীতে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে, যা গবেষকদের চোখে অবর্ণনীয় সাফল্য। তবে ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল জানা গেলেও ভাইরাসটি ঠিক কোন প্রাণির মাধ্যমে প্রথম ছড়িয়েছে তা নিয়ে গবেষকরা এখনো নিশ্চিত নন।
যাই হোক, অন্য কোন সময়ের চেয়ে একক বিষয়ে সবেচেয়ে বেশি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে ২০২০ সালে। স্প্রিঞ্জার- নেচারের তথ্য মতে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত প্রায় ১৪ হাজার পিয়ার-রিভিউ গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে আর তিন হাজার ৭০০ প্রি-প্রিন্ট জার্নালও কোভিড-১৯ গবেষণা উঠে এসেছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানকে সাহসিকতার সাথে কাজে লাগিয়ে ভয়ানক এ ভাইরাসের কবল থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দেওয়ার যে যুদ্ধ, সেটি দেখেছে এবং এখনো দেখছে পুরো বিশ্ব। প্রকৃতির কাছে অসহায়ত্ব বরণ না করে, নিজেদের মেধা ও প্রজ্ঞাকে যথোপযুক্ত প্রয়োগ করে, করোনাভাইরাসকে দমনের লক্ষ্য পৃথিবীর বিজ্ঞান ও গবেষণায় যেকোনও সময়ের চেয়ে সেরাটি দিয়েছে আমাদের গবেষকরা।
যেদেশ মনে করে গবেষণায় টাকা ঢালা মানে উত্তপ্ত বালিতে কয়েক ফোঁটা জল ঢালা, তাদের কাছে ২০২০ সাল উদাহরণ হিসেবে প্রজ্বলিত থাকবে। বিজ্ঞান গবেষণায় উদাসিনতার চেয়ে, মনযোগী হওয়ার যে প্রচ- চাপ, তা রাষ্ট্র প্রধানদের অনুভব করতে হবে।
গবেষকদের উপর আস্থা রেখে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ২০২০ স্মৃতির পাতায় ‘ব্লাক ইয়ার’ হিসেবে চিহিৃত হবে। স্বজন হারানোর বেদনা আর বছর শেষে ভ্যাকসিনের প্রাপ্ততা বিজ্ঞানকে আরেক দফা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ পেল, তা কম কিসের? আর এভাবেই হয়তো আগামী বছর হয়তো কোন কার্যকরী কোভিড-১৯ ওষুধও আমরা দেখতে পাব। আমরা চাই, স্বীয় উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে এই পৃথিবী আবার বসবাসযোগ্য এই কামনা প্রতিটি মানবের।
লেখক : প্রাবন্ধিক