৫ নারী ‘দালালে’ অতিষ্ঠ রোগীরা

চমেক হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড

নিলা চাকমা »

বোনকে নিয়ে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে এসেছেন ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সায়মা সুলতানা (ছদ্মনাম)। মূল ফটকে তাদের আটকে এক মধ্যবয়সী নারী জিজ্ঞেস করেন, কি রোগী?। সায়মা জানান গাইনি বিভাগের আউটডোরে চিকিৎসককে দেখাতে এসেছেন। পরে গাইনি বিভাগের চিকিৎসক বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিলেন। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষার কাগজ নিয়ে বের হতেই তাকে ঘিরে ধরলেন আরো ৩ মধ্যবয়সী নারী। হাসপাতালে এসব পরীক্ষা হয় না এমনটা বলে এক পর্যায়ে সায়মা ও তার সাথে আসা অন্যদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিতে চাইলেন মধ্যবয়সী নারীরা। কিন্ত সায়মা তাদের কথা না শুনে সোজা প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে পরীক্ষা করালেন।

এভাবে প্রতিনিয়ত এই বিভাগের রোগীদের হয়রানি করছে ৫ নারী ‘দালাল’। ‘পুরুষ দালালদের’ আটক করা হলেও এই নারীরা প্রতিবারই অধরা থেকে যায়।

চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে ১০ জন ‘দালাল’ আটক করা হয়। এটিই এক মাসে সর্বোচ্চ আটক সংখ্যা। আটককৃতরা হলেন, জুয়েল (৫০), সবুজ (২৫), মো. সুমন (২২), মো. মইন উদ্দিন (৩২), রয়েল দে (২৭), আলম বাবু (৪১), মো. জিসান (২৪), মো. ফরহাদ (৩৪), মো. জুয়েল (২৩) আদনান সিকদার (২২)। এভাবে গত বছর প্রায় ৯০ থেকে ১২০ দালালকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের।

চলতি বছরের ১১ নভেম্বর ৬ ‘দালাল’কে আটক করা হয়। তারা হলেন আলাউদ্দিন প্রকাশ মাসুদ (৪২) , জুয়েল ইফতেখার শাওন (২৯), সজীব হাওলাদার (২৪), সজীব হাওলাদার (২৪), শামীম (২৮) ওমর ফারুক (৩২)। এছাড়া জানুয়ারিতে ৬ এবং এপ্রিলে ৩ জনকে আটক করা হয়। এভাবে চলতি বছর ১২০ জনের মতো ‘দালাল’ আটক করা হয়েছে দাবি পুলিশের।

গর্ভবতী নারীরা টার্গেট
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে প্রায় প্রতি মাসে ‘দালাল’ আটক করা হয়। কিন্ত প্রতিবারই এই ৫ জনের সিন্ডিকেটটি অধরা থেকে যায়। তাদের টার্গেটে থাকে গর্ভবতী নারীরা। টাকা দিয়ে তারা সব ব্যবস্থা করে রাখেন এমনটা দাবি করেছেন হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী।

কারা আছেন এই সিন্ডিকেটে
রিতা চৌধুরী, কৃষ্ণা দে, মমতাজ বেগম, শাহানাজ বেগম এবং রিনা দে। তারা সবাই মধ্যবয়সী। সিন্ডিকেটের সর্দার হিসেবে থাকেন রিতা চৌধুরী। তিনি সব সময় সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত চমেক হাসপাতালের মূল ফটকে থাকেন। আর তাকে সহোযোগিতা করেন মমতাজ বেগম, কৃষ্ণা দে। মূল ফটক দিয়ে যেসব রোগী আসেন তাদের সকলকে তারা হয়রানি করেন। হাসপাতালে ‘এই সেবা নেই, পরীক্ষা নেই’ এসব বলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগীদের পাঠান তারা। আর তার বিনিময়ে মোটা অংকের কমিশন পান তারা।

সিন্ডিকেটের বাকি ২ জন শাহানাজ বেগম এবং রিনা দে দায়িত্ব পালন করেন হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ড গাইনি বিভাগে। যখন রোগীরা রিপোর্ট পরীক্ষার জন্য বের হন ঠিক সেই সুযোগকেই কাজে লাগান তারা। রোগীদের তারা ‘এই হাসপাতালে এই পরীক্ষা নেই, এটা নেই, ওটা নেই’ বলে বাড়তি টাকায় পরীক্ষা করান। অথচ হাসপাতালেই গর্ভবতী নারীদের সকল পরীক্ষা করা যায়। কোনো পরীক্ষার জন্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ল্যাবে ছুটতে হয় না।

এদিকে গর্ভবতী নারীদের সকল পরীক্ষা হাসপাতালে হয় এমনটা জানিয়েছেন ওই বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. প্রিয়াংকা ওয়াদ্দার। তিনি বলেন, সন্তান গর্ভাবস্থায় থাকার সময় নারীদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। যেমন- ডায়াবেটিস, জন্ডিস, রক্তশূন্যতা, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, এক্সরে, সিটি স্ক্যানসহ নানা পরীক্ষা। বর্তমানে সিটি স্ক্যান বন্ধ থাকায় বাকি সব পরীক্ষা করা যায়। সিটি স্ক্যানও হাসাপাতালের পাশে নিউক্লিয়ার অফ মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড (চট্টগ্রাম) বা লাল বিল্ডিংয়ে করা যায়। সব পরীক্ষা সরকারি খরচে করা যায়। কোনো রোগীকে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হবে না। সকল রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানেই করা যাবে।

‘দালালরা’ রোগীদের হয়রানি করে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, শুনেছি ‘দালালের’ কথা। তারা রোগীদের হয়রানি করেন। কিন্ত কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেন নি। অভিযোগ করলে সেটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আমরা ব্যবস্থা নিতাম। জানা গেছে, গাইনি আউট ডোরে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। সেখানে গর্ভবতী নারীদের সেবা দেওয়া হয়। একই সাথে জরায়ু ক্যান্সার রোধে স্কিনিং, ভায়া স্ক্যানিং পরীক্ষা করা হয়। এই ওয়ার্ড থেকে রোগীদের রেডিওলোজি ও প্যাথলজি বিভাগে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।

গতকাল মঙ্গলবার ওই ওয়ার্ডে সেবা নিতে আসা জান্নাতুন নামে এক রোগী বলেন, এই দুই মহিলা (শাহানাজ এবং রিনা দে) আমার পরীক্ষা নিরীক্ষার কাগজ ছিনিয়ে নেয়। তারা বার বার বলতে থাকে এখানে এই পরীক্ষা হয় না। এ সময় তারা বেসরকারি একটা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলেন। শুধু আমি না সকলকেই তারা এভাবে হয়রানি করেন। পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের এখানকার স্টাফ বলে পরিচয় দেন।’

‘নারী দালাল’ কেন আটক হয়না এমন প্রশ্নে চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনর্চাজ নুরুল আলম আশেক বলেন, চলতি বছরের শুরুর দিকে ৩ নারীকে আটক করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এরপর কোনো অভিযোগ আসেনি। এছাড়া আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। পুরো হাসপাতাল কাভার দেওয়া সম্ভব হয় না। একই সাথে নারী পুলিশ কর্মকর্তা নেই। আমাদের কাছে ‘নারী দালাল’ নিয়ে অভিযোগ আসেনি। তবে আমরা এবার তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করবো।

এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘নারী দালাল’ নিয়ে অভিযোগ আসে নি। তবে যে ওয়ার্ডে তারা এতদিন ফাঁদ পেতে রয়েছে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’