‘হঁঅলা’ : চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান

অমল বড়ুয়া

মানবজাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিবাহ নামক পূত-পবিত্র ও শুদ্ধতম সামাজিক রীতি। আর এই বিয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে আছে বিভিন্ন প্রথা, আচার-অনুষ্ঠান, লোকাচার ও বিয়ের গানের মতো মননশীল বিষয়ও। এই বিয়ের গানগুলো হলো বাংলা লোকগান তথা লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যের অংশ। বাঙালি সংস্কৃতিতে লোকগানের যে কয়েকটি ধারা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার মধ্যে বিয়ের গান অন্যতম। লোকসাহিত্যের এক অমূল্য ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এ গান। যা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আবহমান বাংলার গ্রাম-জনপদের অধিবাসীদের কন্ঠ থেকে উত্থিত এই সঙ্গীতের রয়েছে সাহিত্যমূল্য, কাব্যগুণ ও শ্রুতিরসের পরিপূর্ণ সুষমা। অঞ্চল ও সম্প্রদায় ভেদে লোকসংস্কৃতির তারতম্য দেখা গেলেও বিয়ের গানের লোকসংস্কৃতির প্রভাব একই দেশে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে কমবেশি পরিদৃষ্ট হয়। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ও সংস্কৃতির চারণভূমি চট্টগ্রামেরও রয়েছে নিজস্ব লোকঐতিহ্য বিয়ের লোকগান- ‘হঁঅলা’।
চট্টগ্রামে লোকগানের কয়েকটি ধারার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। এগুলো হচ্ছে- ক) প্রেম-সঙ্গীত, খ) হঁঅলা বা বিয়ের মেয়েলি গান, গ) মারফতি গান, ঘ) কবিগান, ঙ) জারিগান বা মহরম সঙ্গীত, চ) উজ্জীবনী সঙ্গীত, ছ) গাইনের পালা বা গাজীর গান, জ) পুস্তিকা কবিতা। চট্টগ্রামের এ সকল গানকে অনেকে আঞ্চলিক গানও বলে থাকেন। এই গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রামীণ লোকগান হল ‘হঁঅলা’ বা বিয়ের গান। ‘হঁঅলা’ তথা বিয়ের এই গানগুলো মূলত চারভাগে বিভক্ত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
ক. হঁঅলা বা বিয়ের গান। ‘হঁঅলা’ এক প্রকার চাটগাঁইয়া মোর্চা-সংগীত; এই সংগীতের সুর এমনভাবে করা হয়েছে যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বানিয়ে-বানিয়ে গাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন ‘হঁঅলা’র উৎপত্তি চাটগাঁইয়া পুঁথিসাহিত্য থেকে। আবার অনেক পণ্ডিতের মতে, চর্যাপদেও রয়েছে লোকগানের ছোঁয়া। চর্যাপদ শুধু প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেরই নিদর্শন নয়, প্রাচীন বাংলা গানেরও নিদর্শন। প্রতিটি পদের শুরুতে রাগ-তাল ও প্রতি জোড়পদে ‘ধ্রুব’ শব্দের উল্লেখ থাকায় নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে, এগুলি তখন গান হিসেবে গাওয়া হতো। চর্যার ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের হঁঅলার উৎপত্তি অসম্ভব কিছু নয়।
খ. চেয়ার। এই শব্দের উৎপত্তি ‘শেয়র’ থেকে। বিশেষ করে উর্দু গজল বা শেয়র আর হিন্দি গান এই শ্রেণিতে পড়ে।
গ. পুরোনো বাংলা আর আঞ্চলিক গান এবং ঘ. বিয়েকেন্দ্রিক কিছু গান।

হঁঅলা বা বিয়ের গান এক প্রকার লোকগীতি। বিয়েতে গ্রামের মেয়েরা একক বা দলবদ্ধভাবে এ গান পরিবেশন করে। তারাই এ গানের রচয়িতা, সুরকার এবং কন্ঠশিল্পী হিসেবে তাৎক্ষণিক মুখে মুখে গান পরিবেশন করে। হঁঅলা সংগীতে সাধারণত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। বেশির ভাগ হঁঅলা সংগীতের সুর করুণ ও আবেগধর্মী। গায়ে হলুদ, মেহেদি তোলা, সোহাগ মাগা, জলভরণ, বরকনে স্নান, কনে সাজানো, বরবরণ, বরকনে বিদায়, বিয়ে অনুষ্ঠানের প্রায় প্রতিটি পর্বে হঁঅলা পরিবেশিত হয়।
হঁঅলা সংগীতে একদিকে যেমন নারীমনের কামনা-বাসনা প্রকাশ পায়, তেমনি লঘু হাস্যরস, কৌতুক ও ঠাট্টা-মশকরাও স্থান পায়। এক কথায় হঁঅলা সংগীত গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত নারীর মনের অকৃত্রিম প্রকাশ। এই সংগীত গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই হঁঅলা লিখিত বা সংকলিত গান নয়। বরং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে মূলত শ্রুতিধরের মৌখিক ব্যবহারই এর প্রাণ। অর্থাৎ মুখে মুখে এ গান চলে আসছে।
হঁঅলা হলো এ রকম :
‘ফঁইরেঘোনা বিলের মাঝে তোতার ঝাঁক বইস্যে, সোনামিয়া দুলা তোতা মাইত্তু গেইয়্যে রে মোর হায় হায় রে …
বউ আনতে যাওয়ার মুহূর্তে, যাওয়ার পথে আর বউ নিয়ে আসার সময় ও পরে হঁঅলা গান গাওয়া হয়। চট্টগ্রামের হঁঅলা গানের তাল, ছন্দ, লয় ও সুরের জাদু না থাকলেও এতে একধরেনর আকর্ষণ লক্ষ করা যায় :
‘দুলর মা দোয়া গরো, দুনো হাত তুলি
আঁজিয়া ফঁইরেঘোনার আরফাত মিয়ার বিয়া’
বউ আনার সময় দেবর-ননদেরা গান ধরে :
‘ভাবীর চোগত কাজল,
ওঁডত পালিশ দিইয়ে লাল গরি,
ধীরে ধীরে চলো রে স্বামীর বাড়ি …’
এই ‘হঁঅলা’ চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিয়েতে গাওয়া হয়। বৌদ্ধসমাজে এককালে প্রচুর বিয়ের গান প্রচলিত ছিল। গ্রামের সাধারণ বৌদ্ধদের মধ্যে এই ঐতিহ্য এখনো দেখা যায়। তবে ইদানিং অব্যবহারে এসব ছড়া ও গানের অধিকাংশ হারিয়ে গেছে। নেই কোন সঙ্কলন গ্রন্থও, গবেষণায় আগ্রহীর সংখ্যাও নগণ্য। যা হোক, বাপের বাড়ি থেকে বিদায়লগ্নে বৌদ্ধ কনে মনের দুঃখে চোখের জল মুছতে মুছতে বলছে :
‘ঢোল বাজে আর মাইক বাজে
আঁর পরাণে ক্যান গরের
ক্যান গঁরি আঁই যাইঁয়ুম পরের ঘর’…
বাঙালি হিন্দু সমাজেও একইভাবে প্রচলিত আছে এই ‘হঁঅলা’ বা বিয়ের গান। অশীতিপর বৃদ্ধা তাঁর স্নেহের নাতনির বিবাহবাসরে শুনিয়ে দেন এমন দুই-একটি গানের কলি, যেমন :
‘আইলাম সই তোদের বাড়িত মালা দিতে
মালা দিতে লো সজনী বর দ্যাখতে
আঁই রসেরও মালিনী
রসের খেলা কতই জানি।’
বিবাহকর্মকে ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত পুণ্যকর্ম বলে গণ্য করা হয়। চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজেও প্রচলিত আছে সহস্রাধিক বিয়ের গান। হিন্দুসমাজের মতোই বাঙালি-মুসলমান সমাজে বাসরজাগা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার গানের রেওয়াজ আছে। বরকনেকে মাঝে রেখে মেয়েরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে এই গান গায় :
‘তার-ই-তসন (অপূর্ব সুন্দরী) মেয়ে আঁর,
জামাই ক্যান মোর কালা গো?
হোক না মা তোর কালা জামাই,
আঁধার ঘরে ভালা গো।
তার-ই-তসন মেয়ে আঁর,
জামাই ক্যান মোর দাঁততো গো?
হোক না মা তোর দাঁততো জামাই,
কচু ছিলবার ভালা গো।’
হঁঅলা গানের মধ্যে যেমন গ্রামীণ মহিলাদের দুঃখ-বেদনা আর বিরহের অন্তর্জালা আছে, তেমনি আছে আনন্দরসের ফল্গুধারা।
আছে নিটোল রসিকতার অপূর্ব আবেশও :
‘আঁর পরানে ছইট ক্যা গরের ও মাইজ্জ্যা বু বইন রে
আঁই এক্কানা বাড়ি পাক্কাই আঁইসয়ুম রে
বাড়ি পাক্কাই আইবার সমত গুরা দুলা দ্যাখে
গুরা দুলা ঝাপটা মারি ধইরজ্জে রে
ঝাপটা মারি ন ধইরজ্জু রে গুরা দুলা ভাই রে
আঁর গায়ে আছে আসট্ট মাইস্যা দাদু রে
আইলর কোনত বাসা বাঁধি চাইরো বইনে নাচে
কন বইনর নাচা বেশি সুন্দর রে
যে বইনে নাচিত পারে মাইকর তালে তালে
সেই বইনে পাইবু রে বকশিস রে …
চট্টগ্রামের বিয়ের গানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আনোয়ারার মনুমিয়া ও বাঁশখালীর মলকা বানুর বিয়েতে গাওয়া গানটি। জনশ্রুতি আছে, মলকা বানু ও মনুমিয়ার বিয়ে হয়েছিল খুব জাঁকজমকভাবে। একমাস ধরে চলেছিল তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান। আর সেই বিয়েতে বিভিন্ন স্থান থেকে শিল্পীরা এসে গান পরিবেশন করেন। তার মধ্যে :
‘মলকা বানুর দেশেরে,
বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজেরে।
মলকা বানুর সাতও ভাই,
অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই।
মলকার বিয়া হইবো, মনু মিয়ার সাথেরে।’
এই গানটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে, গ্রামে-গঞ্জে গানটি এখন কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
বাংলার খ্রিস্টানদের বিবাহবাসরে কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রচলিত ছিল ‘নবদো’। বিলেতফেরত জনৈক পাদরি ল্যাটিন ভাষায় এই শপথ-কবিতাটি রচনা করেছিলেন বাঙালি খ্রিস্টানদের জন্য। এর অর্থ না বুঝে গড়গড়িয়ে মুখস্থ বলে যেত বাংলাভাষী বর। বেচারার এতটুকু ত্রুটি ঘটলেই হাসির রোল পড়তো। আবার প্রথম থেকে আবৃত্তি করতে হত। তবে এখন ‘নবদো’ নেই। তা সময়ের বিবর্তনে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে ‘হঁঅলা’র জনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। ‘হঁঅলা’র জনপ্রিয়তায় আপ্লুত হয়ে ১৯৭০ সালে আবদুল গফুর হালী রচনা করেন একটি জনপ্রিয় হঁঅলা, যা ইতোমধ্যে গ্রামীণ জনজীবনের একটা অমলিন অংশে পরিণত হয়েছে :
‘আইওরে আইওরে কুডুম
দুলা হাঁজাইতাম।
কাঁচি হলইদে আনরে বাডি
আনরে মিডা পান
কুডুম আইওরে।
ভালা গরি বইও দুলা
পশ্চিম মিক্ষা হই
আঁক কুলারে মাথাত লইত
দুলার মা গেল কই।’
‘হঁঅলা’ নামক এই গানগুলো চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ নিদর্শন। চট্টগ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ এই গান। বাংলা লোকগানে চট্টগ্রামের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, ঋদ্ধ ইতিহাস আর পরিশীলিত পরম্পরা। বর্তমানের অবারিত তথ্যপ্রযুক্তির প্রাবল্যে আর অনলাইনভিত্তিক প্লাটফর্মের বাড়াবাড়িতে যুগের সাথে তাল মিলাতে না পেরে বিয়ের গানগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এবং ঐতিহ্যবাহী এই ‘হঁঅলা’র সময়ের গানগুলো। এই গানগুলো আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মানবিক আনন্দ-বেদনার অনিন্দ্য বুননও। তাই এই গানগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে উত্তর প্রজন্মের কাছে অর্পণের দায়বদ্ধতাও আছে। তাছাড়া এই গানগুলো আমাদের লোক সংস্কৃতির অংশ ও জাতীয় সম্পদ। তাই ‘হঁঅলা’র অন্বেষণ, পর্যালোচনা, গবেষণা, সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণে জাতীয় উদ্যোগ জরুরি।