সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ায় সমাজ সচেতনতা

সুজন সাজু :

ছড়া মানেই হাসি খুশি, ছড়া মানেই আনন্দ। ছড়া মানে কৃত্রিমতা নয়, ছড়া মানে বাস্তবতার প্রতিফলন। ছড়া বাংলা সাহিত্যের আদি প্রাণস্বরূপ। এক সময় ছড়াকে শিশু মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হলেও সময়ের পরিক্রমায় ছড়া আজ ঘাত-প্রতিঘাতের, প্রতিবাদের, স্লোগানের এক অনন্য কণ্ঠস্বর।

ছড়া অনেকেই লিখেছেন, অনেকেই লিখছেন। কিন্তু যিনি শুধু ছড়া লিখে জনপ্রিয়তার স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছেন তিনি হচ্ছেন সুকুমার বড়–য়া। বিষয়বৈচিত্র্য, উপস্থাপনার ভঙ্গিমা, শব্দচয়ন, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাতœক, ছন্দকুশলতা ও অন্তমিল ব্যবহারে অপূর্ব সমন্বয়ের সামঞ্জ্য তার ছড়াকে দিয়েছে স্বতন্ত্রতার আলাদা বৈশিষ্ট্য। যার ছড়া পড়েই বিমুখপাঠকও ছড়াপাঠে বাধ্য ছাত্রে পরিণত হয়। ছড়ার প্রতি পাঠককে ঝুঁকে পড়ার সঞ্জীবনী সঞ্চারে যার জুড়ি  মেলা ভার। তার অসংখ্য ছড়া ছোটবড় অনেকের হৃদয়ে দেদীপ্যমান। তার একটি প্রতিবাদের ছড়া, যেটি রচনা করেছিলেন পাকিস্তান আমলে, আইয়ুব খানের দুঃশাসনের প্রতি ইঙ্গিত করে ঊনসত্তর সালে। যখন সারা দেশজুড়ে বৈরী পরিস্থিতি, ঠিক সেই সময়ের ঘটনা প্রবাহকে রূপ দিলেন ছন্দের কারিশমায় :

চিচিং ফাঁক হে চিচিং ফাঁক।

বনময়ুরের পুচ্ছ পরে,

নাচছিল সব শকুন-কাক

দমকা ঝড়ে হঠাৎ করে

ঘটিয়ে দিলো ঘোর বিপাক,

চিচিং ফাঁক হে চিচিং ফাঁক।

গোলাগুলির মহান দশক

রোগীর ঘরে বাড়ল মশক

তোমার পাতে কোরমা-পোলাও,

আমরা না পাই কচুর শাক

চিচিং ফাঁক হে চিচিং ফাঁক।

হাসতে মানা কাঁদতে মানা

হানার উপর চলছে হানা

স্বাধীন দেশের আজবরীতি

মুখ থেকেও রুদ্ধবাক্

চিচিং ফাঁক হে চিচিং ফাঁক।

এমনি  করে আজব দেশে

মানুষগুলো যাঁতায় পেষে

হঠাৎ করে জ্বললো আগুন

পালায় শকুন, কাকের ঝাঁক

চিচিং ফাঁক হে চিচিং ফাঁক।

বাঙালিদের জীবনযাত্রায় দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত অবস্থাকে সুনিপুণভাবে তার ছন্দের যোজনায় তুলে ধরেছেন একটি কালজয়ী ছড়ায় :

অসময়ে মেহমান

ঘরে ঢুকে বসে যান

বোঝালাম ঝামেলার

যতগুলো দিক আছে।

তিনি হেসে বললেন

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

রেশনের পচা চাল

টলটলৈ বাসি ডাল

থালাটাও ভাঙাচোরা

বাটিটাও লিক আছে

খেতে বসে জানালেন

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

মেঘ দেখে মেহমান

চাইলেন ছাতাখান

দেখালাম ছাতাটার

শুধু কটা শিক আছে

তবু তিনি বললেন

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ষাটের দশকে লেখা যে-ছড়াটি বাস্তবতার নিরিখে এখনো প্রাসঙ্গিক :

বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধি গায়েব মানীলোকের মান,

সত্যবাদীর জিহ্বা গায়েব নির্বিবাদীর কান।

কর্মবীরের শক্তি গায়েব

চিন্তাবিদের ব্রেন,

খাদ্যবাহী নৌকা গায়েব

যাত্রীবাহী ট্রেন।

বীরজনতার মিছিল গায়েব

করতে যাবে কে সে

তারাই আগে গায়েব হবে

বিদ্রোহী এই দেশে।

সুকুমার বড়–য়ার আরেকটি ছড়া :

শিয়াল নাকি লোভ করে না

পরের কোনো জিনিসটার,

কী পরিচয় দিল আহা

কী সততা কী নিষ্ঠার!

তাই সে হল বনের মাঝে

এডুকেশন মিনিস্টার।

কী অসাধারণ অন্ত্যমিল! এমন মুনশিয়ানায় ছন্দের দোলনা সুকুমার বড়–য়ার হাতেই সম্ভব। বর্তমান অনেক নেতাই সাধারণ জনগণের সম্মূখে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ফাঁকা বুলি ছোড়ে, বাস্তবে নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। সেটাকে চট্টগ্রামের ভাষায় ছন্দে রূপ দিলেন চমৎকারভাবে :

লালমিয়া তো বিরাট নেতা

রাস্তাঘাডে ফাল মারে।

দিনত বড় ভালামানুষ

রাইত দুপুরে জাল মারে।

গরিবরলাই কাঁদি কাঁদি,

টেঁয়া-পইসার টাল মারে।

ছড়াসাহিত্যের কিংবদন্তি সুকুমার বড়–য়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পেয়েছেন অগণিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংবর্ধনা আর মানুষের উজাড় ভালোবাসা। এই নিরহংকার মানুষটি জন্ম নিয়েছেন চট্টগ্রামের রাউজান থানার মধ্যম বিনাজুরি গ্রামে ১৯৩৮ সালের ৫ জানুয়ারি। শৈশবে আর্থিক অনটনের মাঝেও অদম্য সুকুমার দমে যাননি একটুও।

স্বশিক্ষিত সুকুমার বড়–য়া শুধু ছড়া লিখেই ছড়াসাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট।