উন্নত ও সমৃদ্ধ পৃথিবীর প্রত্যাশা

রায়হান আহমেদ তপাদার »

বর্তমান বিশ্বে আসল হুমকি মোকাবিলায় দেশে দেশে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর উদাসীনতা নগ্নভাবে চোখে পড়ে। যার ফলে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা এবং একই সাথে তা বেসরকারি খাতের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়ার হুমকি মোকাবিলার মুনাফাসর্বস্ব এক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ আপেক্ষিক পতন পর্যায়ে থাকার ফলে ক্ষমতার এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো উদীয়মান শক্তিগুলো তাদের ক্রমবর্ধমান উত্থান সত্ত্বেও পূরণ করতে এখনো সক্ষম নয়। যার ফলে এই শূন্যতাকে ঘিরে তৈরি হওয়া নতুন নতুন হুমকি এবং তা মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার পরিবর্তে স্বার্থের প্রতিযোগিতাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
তবে বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্র পরিবর্তনের একটি ঝোঁক বিদ্যমান, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে বিজয়ী শক্তিগুলোর একরকম চাপিয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের কাঠামো বিচারে বলা যায়, এর মাধ্যমে সরকারগুলোর স্বার্থসংরক্ষণই শুধু সম্ভব, যা বৈশ্বিক জনস্বার্থের পরিপন্থী। যার ফলে পৃথিবী এবং মানুষের ওপর ক্রমবর্ধমান হুমকিগুলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনতা উভয়ই ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা করছে। পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকারের ক্রমাগত লঙ্ঘন এবং গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ হুমকি মোকাবিলার চেয়ে সরকারগুলোর শুধু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টার প্রতিফলন।
অন্যদিকে বৈশ্বিক রাজনীতির বিশ্বায়িত জনপরিম-লে ধর্মের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন খুব আশ্চর্যজনক কিছু নয়। পশ্চিমে সেক্যুলারিজমের প্রতি ঝোঁক একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এটা শুধু যে অপশ্চিমা দেশ, যেখানে সেক্যুলারিজমকে বিদেশি আরোপণ হিসেবে দেখা হয়, সেখানেই প্রযোজ্য তা নয়। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতেও অনেক নাগরিক মনে করেন যে সেক্যুলারিজম তাদের চূড়ান্ত মূল্যবোধের ক্ষয়সাধন করে চলেছে, যার ফলে তারা আরও উগ্রবাদী বিশ্বাসে প্রবোধ খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর এই সুযোগে দেশে দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধর্মোন্মত্ততাকে তাদের বক্তৃতা এবং অনেক সময় কাজেও অপব্যবহার করছে। যার ফলে আজকের বিশ্ব সেক্যুলার-ধার্মিক পরিচয়ে বিভাজিত হওয়ার হুমকিতে পড়েছে।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ এই অবস্থাকে আরও শোচনীয় করেছে। দেখতে দেখতে একটি বছর শেষ হয়ে গেল। নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ২০২০ সাল প্রকৃতির নিয়মেই অতিক্রান্ত হলো। আলোচনা-সমালোচনা উপচেপড়া ঢেউয়ের বছরটি মানবহৃদয়ে বহুমাত্রিক রেখা অঙ্কন করে দিয়েছে। আনন্দ-বেদনার সমন্বিত ভাবনায় কখনও অস্থির কখনও স্বস্তির পরিবেশকে আলিঙ্গন করেই চলতে হয়েছে মানবসমাজকে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত সভ্যতা। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অচেনা এ রোগটি। ৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন মানুষ, সংক্রমণের গতিও প্রবাহমান।
যা হোক, পুরোনো অব্যবস্থাপনা-অসচ্ছতা ভুলে তেজোদ্দীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। পদ্মা সেতু যেখানে নিজস্ব অর্থায়নে করতে সক্ষম, সেখানে পেছনে তাকানোর সুযোগ কোথায়? আমরা বীরের জাতি। যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্ম হয়, শেখ হাসিনার মতো দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে, অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়, সে দেশের আবার ভয় কী? আগামীতে আমরা চাই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক জীবন। সমগ্র মানবজাতির জন্য স্বাভাবিক সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করি। মানবজাতি এমন এক সত্যকে ধারণ করে জীবনচর্চায় এগিয়ে যাবে, যে সত্য মানবসত্তা বিশ্বাসে ক্রিয়াশীল থাকে। সে সত্যটি হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। আধুনিক এ বিজ্ঞান সভ্যতায় পাশ্চাত্য মনস্তত্ত্বে চেতনাবিষয়ক পর্যালোচনা গুরুত্ব পাচ্ছে। এ যাবৎ ওখানে তার স্থান ছিল না। বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করছে নানাদিক থেকে। তাত্ত্বিক দিক থেকে পদার্থবিদ্যা বা জীববিদ্যা পর্যালোচনার সময় মানবসত্তার নিহিত কিছু নিগূঢ় বস্তুর সত্যতা সম্বন্ধে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কার্যকারিতার দিক থেকে মানবীয় পরিস্থিতিও নজরে পড়ে। মানবীয় মনস্তত্ত্বও ভিন্নরূপ নিয়েছে, প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভূত উন্নতির কারণে। ভৌত বিজ্ঞান এ সমস্যাকে বেশিদিন উপেক্ষা করে চলতে পারে না। বৈশ্বিক ভাবনায় এ এক নতুন সংযোজন। বিশ্বের মানুষ যদি জীবনে শান্তি চায়, পূর্ণাঙ্গ সাফল্য চায়, তবে মন ও চেতনা নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। এটি একটি তত্ত্ব। এ প্রত্যেক তত্ত্বেই মানবমুক্তি। অপরদিকে মানুষ কাজের সুবিধার জন্য আরও ছোটখাটো সাজসরঞ্জাম, নিত্যপ্রয়োজনের জন্য আরও কিছু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়িয়েও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে পারবে না। যদি না জীবন চর্চায় অভ্যস্ত হয়। অশুভের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গিতে মনুষ্য সমাজকে কাজ করতে হবে।
নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা পরজীবী হয়ে কতদিন বাংলাদেশে থাকবে? রোহিঙ্গাদের স্বদেশে সম্মানজনক ভাবে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থাটা করতে হবে সম্মিলিতভাবে। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়। এটা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। মানবতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে।
আধুনিককালে কোনো সমস্যাই এখন আর কোনো দেশের একক সমস্যা ভাবা ঠিক নয়। পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজ। বহুত্ববাদ মতবাদ হিসেবে আজ সর্বস্বীকৃত। এ মতবাদের ভিত্তিতে গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠিত হোক। আগামীর বিশ্ব হোক শান্তিময়, ঐশ্বর্যময় ও সংস্কৃতিময়। বিশ্ব নেতারা এমন এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ হোক, কেউ কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করবে না। কেননা বর্তমান সভ্যতার জগতে এককভাবে কোনো দেশই চলতে পারবে না। পারস্পরিক নির্ভরতার দেশগুলোকে অভিন্ন চেতনায় এগুতে হবে সম্মিলিতভাবে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্মের অপব্যবহার, পরধর্মের নিন্দা চর্চার অবসান ঘটুক। সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক।
ঐক্যবদ্ধভাবে সব দোষের উৎস করতে হবে ধ্বংস। সব মানবজাতিকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মনঃশক্তি উন্নয়নের যুদ্ধ করতে হবে নিজের সঙ্গে। এ যুুদ্ধ চালাতে হবে মানবিক ক্রমবিকাশের উচ্চতর লক্ষ্যে। এমন যুদ্ধ পৃথিবীতে বাহ্য যুদ্ধের প্রবণতাকেও দূর করবে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান ও শিক্ষা-গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে সম্মিলিতভাবে। পর্যায়ক্রমে উন্নত ও সমৃদ্ধ মানবজাতি গঠনে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন অপরিহার্য। সারা বিশ্বেই এটা প্রযোজ্য। জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
বহুলআলোচিত করোনার আলোচনা কতদিন প্রলম্বিত হবে তা অজানা। তবে এ নিয়ে সারা বিশ্বেই রাজনীতি হয়েছে,এখনও হচ্ছে।করোনাকেন্দ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতির সমান্তরাল অবস্থা থেকে মানবজাতি কী শিক্ষা পেল তা আগামীতে প্রমাণিত হবে। অর্থনীতিকে প্রচ- ধাক্কা দিয়ে কোভিড-১৯ জনজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। থমকে গেছে জীবনের গতিপ্রবাহ। অসংখ্য মানুষ চাকরিহারা হয়েছে, কর্ম হারিয়েছে। ওখঙ-এর তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৯ কোটি ৫০ লাখ লোখ কর্ম হারিয়েছে। এর মধ্যে এশিয়ায় ১২ কোটি ৫০ লাখ, ইউরোপে ১ কোটি ২০ লাখ, আমেরিকায় ২ কোটি ৫০ লাখ, আফ্রিকা মহাদেশে ৩ কোটির মতো, মধ্যপ্রাচ্যে ৫০ লাখ সম্পূর্ণরূপে কর্মহীন হয়েছে। শতকরা হিসেবে সারা পৃথিবীতে ৬.৭ শতাংশ লোক বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়েছে।
বর্তমান পৃথিবীতে রাজনৈতিক অগ্রগতি বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয় নয়। মানুষ ২০২১ সালে একটি শঙ্কা ও সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব দেখতে চায়। আর এটার জন্য সারা বিশ্বেরই প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এটা করতে গিয়ে যদি আগামী পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি কম হয়, অর্থনৈতিক অগ্রগতি যদি অতটা না-ও হয়, তারপরেও যদি প্রতিহত করতে পারি, বিশ্ববাসীর জন্য সেটাই মঙ্গল।
এখন সারা বিশ্বে যে অভিবাসন হচ্ছে এটা তো সাধারণ অভিবাসন নয়। এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে একজন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যে তিনি তাঁর পুরো পরিবার নিয়ে ছোট একটা ডিঙিতে সাগর পাড়ি দিয়ে আরেক দেশে চলে যাবেন। এর চেয়ে শক্ত সিদ্ধান্ত তো আর হয় না। এটা হচ্ছে সন্ত্রাস ও সহিংসতার কারণে। এর সমাধান যদি আমরা না করতে পারি তাহলে বিশ্বে অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে, তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা মানব উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে পড়বে । আমাকে যদি কেউ এখন প্রশ্ন করে, সিরিয়ার মতো দেশে মানবউন্নয়নের মানে কী? সিরিয়ায় এখন মানবউন্নয়নের মানে হচ্ছে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখা। ২০ বছর আগে সিরিয়ার যে অগ্রগতি এবং বর্তমানে সিরিয়ার যে অবস্থা, সেটা তুলনা করলেই বুঝতে পারব সন্ত্রাস ও সহিংসতা একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যায়। তাই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা রাষ্ট্র, সমাজে ও ব্যক্তিগত জীবনে যেন এই সতর্কতা থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, যে অর্জন আমাদের হয়েছে সেটা যেন আমরা ধরে রাখতে পারি। সেই সঙ্গে আগামী পৃথিবীর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য যা যা করা দরকার, সেগুলো যাতে অর্জন করতে পারি সে প্রত্যাশাই করি।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স