সফল কানেক্টিভিটিতে নব দিগন্তের উম্মোচন

রামগড় স্থল বন্দর

শ্যামল রুদ্র, রামগড়

খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দর উন্নয়ন কাজ আরও একধাপ এগিয়ে গেল চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট-হেয়াঁকো-রামগড় ৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি এ কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। নির্মীয়মান রামগড় স্থলবন্দরটি পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র পূর্নাঙ্গ স্থলবন্দর। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে আগেই উদ্বোধন হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সেতু -১। যেটি ফেনী নদীর ওপর রামগড় মহামুনি অংশে স্থাপিত। এ সেতু দুদেশকে সংযুক্ত করেছে। বন্দর সংশ্লিষ্ট ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসাবেই এবার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অত্যাধুনিক ও যুগোপযোগী করতে সড়ক প্রশস্তকরণের এ উদ্যোগ। যার উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১১শ কোটি টাকার বেশি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির প্রশস্ততা ৫.৫০ মিটার (১৮ ফুট) থেকে ১১.৩০ মিটার (৩৮ ফুট) করা হবে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৯টি সেতু (২৪৯.২০ মিটার) এবং ২৩টি কালভার্ট (১০৮ মিটার) নির্মাণ করা হবে।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে রামগড় বন্দরটি পুরোপুরি চালু হলে রামগড় থেকে ভারত হয়ে সিলেট মাধবপুর পর্যন্ত নরসিংদী- মৌলভীবাজার সড়কে যুক্ত হয়ে বৃহত্তর চট্রগ্রামের মানুষ ময়মনসিংহ ও সিলেট যেতে পারবেন অনায়াসেই। জনমনে প্রশান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্বে বেনাপোল থেকে কিছু মাত্র কম হবে না রামগড় স্থলবন্দরের উপযোগিতা। যে কারণে স্থলবন্দরটি ঘিরে মিরসরাই ফটিকছড়িসহ উত্তর চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক উন্নয়ন। রামগড় স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যর ব্যাপক প্রসার ঘটবে। চট্টগ্রাম থেকে বেনাপোলের দুরত্ব বেশি। প্রচুর সময় দরকার, খরচও বেশি। পক্ষান্তরে রামগড় বন্দর চালু হলে কম সময় ও স্বল্প খরচে ভারত পণ্যসামগ্রী নিতে পারবে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। এতে দুদেশই লাভবান হবে। এ ছাড়া মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের নানা কর্মকান্ডে রামগড় বন্দর গুরুুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে। আর এ সবই বর্তমান সরকারের অবদান । এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে রামগড় এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছুবে। সড়ক প্রশস্তকরণ ও আধুনিকীকরণের কাজ সম্পন্ন হলে রামগড়ের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ হবে আরও সহজ। এ প্রকল্পে থাকবে ২৪৯ দশমিক ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৯টি ব্রিজ ও ১০৮ মিটার দৈর্ঘ্যের ২৩টি সেতু। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি থেকে বিভিন্ন পণ্য ঢাকায় পৌঁছাতে আরও সময় কম লাগবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দূরত্বের এই স্থলবন্দর ব্যবহার করে মাত্র ৩ ঘণ্টায় ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য যাবে ভারতে। পাশাপাশি এ সড়কের মাধ্যমে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যসহ মেঘালয়, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং অরুণাচলের (সেভেন সিস্টার্স) সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জাতীয় স্বার্থেই ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব দরকার। ভারতের বিনিয়োগ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ হলে অন্য কারো কাছে যাওয়ার দরকার হবে না’। বুধবার (২৪ মে) রাজধানীর তেজগাঁও সড়ক ভবনে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এসময় উপস্থিত ছিলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের সড়ক ও রেল-দুই দিক থেকেই ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আরো নতুন নতুন দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য, লেনদেন বেড়েছে। ফলে উভয় দেশ লাভবান হয়েছে। এগুলো আমাদের আজ স্বীকার করতে হবে। আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই নিজেদের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে এবং আমাদের উন্নয়নের স্বার্থে।’ তিনি আরও বলেন, লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) মাধ্যমে বাংলাদেশে বেশ কিছু বিনিয়োগ এসেছে ভারত থেকে। বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, এটাও এলওসির একটি প্রকল্প। ইতিমধ্যেই রামগড়ে মৈত্রী সেতু-১ হয়ে গেছে। ফলে চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ বাড়বে। পাশাপাশি কক্সবাজার বিমানবন্দর বর্ধিত করার কাজও প্রায় শেষ। বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্ত করণ প্রকল্পটি ভারত সরকারের এলওসি-৩ এবং বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হবে। ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল দিল্লিতে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ৫১৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা আর প্রকল্পে ভারতের ঋণ থাকবে ৫৯৪ কোটি সাত লাখ টাকা। প্রকল্পটি তিনটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রস্তাবিত সড়কটি ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাট থেকে শুরু হয়ে খাগড়াছড়ির রামগড়ে শেষ হয়েছে। রামগড় স্থলবন্দরটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ১০৮ কিলোমিটার ও রাজধানী ঢাকা থেকে ২০৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সুতরাং এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও ঢাকার সঙ্গে ত্রিপুরার সাব্রুম ও খাগড়াছড়ির রামগড় স্থলবন্দরের সংযোগ স্থাপিত হবে।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর কাজটি শেষ করার কথা। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অশোকা বিল্ডকন লিমিটেডকে সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন দু’দেশের জনগণের চাওয়া যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু করা। এর মাধ্যমে আন্ত:দেশীয় ব্যবসা-বানিজ্যে সম্প্রসারণ ঘটবে। উন্মোচিত হবে অর্থনীতির নতুন দুয়ার। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতির সীমারেখা বানিজ্যে বাধা হতে পারে না, শুধু চট্টগ্রাম পোর্ট নয়, চট্টগ্রাম বিমান বন্দরও ত্রিপুরাবাসী ব্যবহার করতে পারে। রামগড় স্থলবন্দর হবে দুই দেশের নতুন বানিজ্যিক করিডোর ।
যে কারণে, এই স্থলবন্দর ঘিরে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশা করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আশা রামগড় স্থল বন্দর সফল কানেক্টিভিটিতে যুক্ত হবে নতুন এক সোনালী অধ্যায়ে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়, বানিজ্য ও পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং মানুষে মানুষে সম্পর্কোন্নয়নে গোটা অঞ্চলের উপকার হবে। বিপুল সংখ্যক মানব সম্পদ কাজে লাগবে অযুত সম্ভাবনার এই কর্মযজ্ঞে। চট্টগ্রাম বন্দরকে পূর্ব ভারতের কমপক্ষে পাঁচ কোটি মানুষ ব্যবহার করবে। তখন প্রচুর রাজস্ব আয় হবে। ব্যবসা-বানিজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়বে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য কলকাতা বন্দরে যেতে ১২শ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় অন্যদিকে চট্রগ্রাম বন্দরের দুরত্ব অনেক কম। ভারতীয়রা সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমনের সুযোগ পাবেন। আবার চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকজনও সহজেই সেভেন সিস্টার্স বেড়াতে পারবেন। অর্থনৈতিক ভাবে এ অঞ্চল হবে সমৃদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম স্থাপিত এই বন্দরের বিশাল কর্মযজ্ঞ দরিদ্র মানুষের মুক্তির নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে। এ বন্দর দুদেশের মানুষের জন্যই হবে আর্শীবাদস্বরুপ। ব্যবসা-বানিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটবে, পুরো এলাকার চেহারাটাই পাল্টে যাবে। সর্বোপরি রামগড় স্থল বন্দর পূর্নাঙ্গভাবে চালু হলে বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচিত হবে নতুন দিগন্তের। আঞ্চলিক গন্ডি ছাপিয়ে এ যেন বিশ্বব্যাপী সেতুবন্ধনের পূর্বাভাস।