সংকট আরও বাড়বে

অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা

সুপ্রভাত ডেস্ক »

প্রস্তাবিত বাজেটকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বর্ণনা করে তা চলমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা।
তারা নিজেদের বিশ্লেষণে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা ডলার সংকট কমানোর জন্য বিশেষ কোনো নীতি কৌশল বাজেটে দেখতে না পাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এই বাজেটে অর্থনীতির চলমান সংকট উত্তরণ হবে না, বরং আরও বাড়বে। রাজস্বের ঘাটতির কথা মনে রেখে সংকট উত্তরণের জন্য দরকার ছিল আরও ছোট আকারের বাজেট। অযথা এরকম উচ্চাভিলাষী বাজেট দিয়ে লাভ নেই।’
‘প্রবৃদ্ধিও হবে না, ইনফ্লেশন কমানো যাবে না। আমরা এখন গ্রোথ পথে চলে গেছি, আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশে চলে গেছি; কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের আলোচনা নেই! আমাদের রাজস্ব নেই, টাকা ছাপিয়ে ব্যয় করতেছি। এটা সাসটেইনেবল না।’
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানে তিনি গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন। খবর বিডিনিউজের।
প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা) চেয়ে ১৫.৩৩ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৫.২১ শতাংশের সমান। বাজেটে আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে রেকর্ড ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। সরকার এই ঘাটতি পূরণে এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা ঋণ হিসাবে পেতে চাইছে। চাহিদার বাকি অর্থের জোগান নিতে চাচ্ছে অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন থেকে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং-সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটের ফোকাস ঠিক নেই। ঠিকমতো প্রায়োরিটিগুলোকে সেট করা যায়নি। সে কারণে বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বলেন, আর মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখা বলেন-এগুলো বাস্তব সম্মত নয়।’
‘প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগে একটা ড্রামাটিক উন্নতির কথা বলা হয়েছে, বর্তমানে জিডিপির ২১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করা হবে- বলা হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ আনরিয়েলিস্টিক। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও এক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এভাবে বাড়েনি। এটা বাড়ানোর জন্য সেভাবে কোনো ইন্ডিকেশনও দেখছি না।’ তাহলে ফোকাস কী হওয়া উচিত ছিল, এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘যেটা আমরা বার বার বলছিলাম যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে অর্থনীতিতে। সামষ্টিক অর্থনীতির একটা বড় ধরনের সমস্যা আছে। সেটিকে কীভাবে ঠিক করা যেতে পারে- তার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে পারতো। বাজেটে সেদিকে আলোচনা দুর্বল। ‘মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে তিনটা জায়গা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটা হচ্ছে মনিটরি পলিসি, ফিসক্যাল পলিসি ও বাজার ব্যবস্থাপনা। এসব বিষয়ে তেমন কোনো কথা নেই। গত এক বছর ধরে ইনফ্লেশন যে কমছে না- সে বিষয়ে তেমন কথা নেই। গত এক বছর ধরে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কার্যকর হয়নি। যেগুলো নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেগুলো নেয়নি।’
অধ্যাপক সেলিম বলেন, ‘তাহলে আমরা কিভাবে বুঝব যে- পরবর্তী অর্থবছরে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হবে, যাতে ইনফ্লেশন কমে আসবে। এগুলো বাজেটে একদমই আলোচনায় নেই।’ ‘মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে ইন্টারেস্ট রেটের ওপর একটা ক্যাপ দীর্ঘদিন ধরে রেখে দেওয়া হয়েছে। সে কারণে ইন্টারেস্ট রেটের মতো অসম্ভব শক্তিশালী একটা ইন্সট্রুমেন্টকে ফাংশন করতে দেওয়া হয়নি। ট্যাক্স পলিসির ক্ষেত্রে যে ধরনের অ্যাডজাস্টমেন্ট করে ইনফ্লেশন কিছুটা ইজি করা যেত, সেরকম বেশি কৌশল দেখিনি।’ বাজেট ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘মোটের ওপর বাজেট ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ঘাপলা রয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের যে লুপহোলসগুলো আছে, প্রতিযোগিতা বিরোধী যে প্র্যাক্টিসগুলো আছে- এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সে কারণে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে দাম কমছে না।’
রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রেও অবাস্তব লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, ‘একটা আনরিয়েলিস্টিক টার্গেট ধরা হয়েছে। কর কাঠামোর বড় ধরনের সংস্কার না করে এই রাজস্ব আহরণ কিভাবে হবে? একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেটা নিয়েও কোনো কথা নেই।’
‘বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ব্যাংক থেকে বড় ধরনের ঋণ নেবে। এই ঋণ যদি ব্যাংক থেকে সরকার নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথায়? বেসরকারি খাত যদি ঋণ না পায়, তাহলে বেসরকারি খাতে এতবড় বিনিয়োগ হবে কোথা থেকে।’ বাজেটের ইতিবাচক দিক বলতে গিয়ে খুব বেশি কিছু খুঁজে পাননি সেলিম রায়হান।
‘হয়তো আর্থসামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভাতাগুলো কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। সেটাও সামান্য। এর বাইরে কার্বন ট্যাক্সের কথা বলা হচ্ছে, ফ্ল্যাট ও জমি রেজিস্ট্রেশনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাজেটের ইতিবাচক দিক। কিন্তু এর মধ্যে এমন একটা জিনিস নিয়ে আসা হয়েছে যে, কেউ যদি ৩৮টা বা ৪৪টা সেবা নিতে যায় তাহলে তাকে বাধ্যতামূলক দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে। একজন নিম্ন আয়ের মানুষ একটা ট্রেড লাইসেন্স নিতে গেলেও দিতে হবে। কিন্তু যারা কর দেওয়ার যোগ্য কিন্তু ফাঁকি দিচ্ছে তাদের জন্য বিশেষ কিছু নেই। পুরো করের ব্যাপারটাই দুঃখজনক।’ বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট জাহিদ হোসেনও মনে করেন সময়োপযোগী বাজেট হয়নি।
তার কথায়, ‘এমন একটা বাজেটের দরকার ছিল- যেটা মূল্যস্ফীতি কমাবে, রিজার্ভের ওপর চাপ কমিয়ে ডলার সংকট কমাবে। যে ঘাটতি ধরা হয়েছে, বাজেটে সেটা মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াবে। রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য সরকার ধরেছে, সেখানে পরোক্ষ করের ওপর বেশি ভর করা হয়েছে। এটার ফলে রান্নাঘরের সরঞ্জাম হতে শুরু করে নিত্যপণ্যের ওপর কর বাড়বে। এটা মূল্যস্ফীতি কমানোর পক্ষে কাজ করবে না, বরং বাড়াবে।’ আইএমএফের শর্তগুলো বাজেটে অতিরঞ্জিত করে প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ‘বাজেটে আইএমএফের কোন শর্তগুলোর প্রতিফলন ঘটছে?
দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব আদায় জিডিপির ০.৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলেছিল আইএমএফ, এতে প্রবৃদ্ধি হয় ১৯ শতাংশ। কিন্তু সরকার রাজস্ব আদায়ে ২৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। ওখানে আইএমএফের পরামর্শ বা শর্তের চেয়েও সরকার এগ্রেসিভ। সুতরাং এটা আইএমএফের পরামর্শের ভিত্তিতে নয়।’ ‘আইএমএফ বলছে, ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। কিন্তু বাজেটে যৌক্তিকীকরণের কিছু তো দেখছি না। রপ্তানি কিংবা রেমিটেন্সে যৌক্তিকীকরণের কী আছে?’
অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য বাজেটে তেমন কোনো কৌশল দেখতে পাচ্ছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার ভাষ্য, ‘কিছু কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ আছে, তবে সেগুলো যে জনগণের কল্যাণ বয়ে আনবে- তাও নয়। কর্মসংস্থান বাড়ানের কোনো কৌশল বাজেটে নেই। সরকার ব্যাংক থেকে প্রচুর লোন নিয়ে নেবে। এগুলো হলে কর্মসংস্থান কভাবে হবে? তাদের কর্মসংস্থান না হলে মূল্যস্ফীতি তারা মোকাবেলা করবে কিভাবে?’
‘ডলার সংকট মোকাবেলা করার জন্য বাজেটে কোনো বক্তব্য নেই। এই পরিস্থিতিতে গ্রোথ রেট ৭ দশমিক ৫ কিভাবে অর্জন হবে?
ভালো বাজেট হয়নি। বড়জোর বলতে পারেন নির্বাচনমুখী বাজেট হয়েছে। কতগুলো প্রকল্প নিয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে জনগণকে সিগনাল দেওয়া যে, আগামীতে আসতে পারলে আরও প্রকল্প নেওয়া হবে।’