শিক্ষক থেকে জাতির বিবেক

শিক্ষাবিদ, লেখক, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুতে সমস্ত জাতি শোকাহত। চট্টগ্রামে তিনি জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কাটিয়েছিলেন।  অনেকেই তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে ড. ভুঁইয়া ইকবাল. ড. মাহবুবুল হক, আবুল মোমেন ও অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ধারণ করা হয়েছিল ফোনে। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো। স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ: কামরুল হাসান বাদল, সহযোগী সম্পাদক, সুপ্রভাত বাংলাদেশ

তাঁর অভাব কখনো পূরণ হবার নয়

ড. ভূঁইয়া ইকবাল

গবেষক, প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়

আমি তাঁকে চিনতাম অর্ধ শতকেরও বেশি কাল ধরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্র ছিলাম। তাঁর আকর্ষণেই আমি চট্টগ্রামে এসেছি। তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষের অভাব আমরা বহুদিন বোধ করব। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। দেশের সব সংকটকালে তিনি উপযুক্ত ভূমিকা পালন করেছেন। দেশ ও জাতি তাঁর অবদানের কথা চিরকাল মনে রাখবেন। তাঁর মত গুণীর অভাব কখনো পূরণ হবার নয়।


 

ভবিষ্যত নির্মাণের অগ্রনায়ক তিনি

ড. মাহবুবুল হক

লেখক ও গবেষক, প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আনিসুজ্জামান স্যারকে আমি ছাত্রজীবনে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর প্রজ্ঞা, বিষয়জ্ঞান, উপস্থাপনা, বিশেষ করে জটিল বিষয়ে সরল এবং সাবলীল বাক্য উপস্থাপনা এগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে। তখন থেকেই আমি তাঁর ভক্ত। আনিস স্যার যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন যাওয়ার পথে তিনি কুমিল্লায় দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছিলেন। তখন রেলওয়ের এক কর্মকর্তা আলী সাহেবের বাসায় এসে উঠেছিলেন চট্টগ্রামে। সেখানে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেই পরিবেশে তিনি অসুস্থ অবস্থায় আমাদের সাথে যে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছিলেন সেটাও আমাদের মুগ্ধ করেছে। এরপরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পাই। শিক্ষক হিসেবে তিনি যে শুধু ছাত্রদের পাঠ দিতেন তেমন নয়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা উন্নয়ন ও নানা কাজকর্মে নেতৃত্ব দিয়েছেন।  শিক্ষকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রতিকূল পরিবেশে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন এবং আগরতলায় তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁর গাড়ি নিয়ে তিনি আগরতলায় গিয়েছিলেন। সেই গাড়িতে চড়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কাজে। পরে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং জাতীয় কার্যক্রমে অংশ নেন সেগুলোর কথা আমরা সবাই জানি।

আনিস স্যার তাঁর সারাজীবনে সবসময় গণমুখী ও মানবতাবাদী ভাবনায় ভাবিত ছিলেন। তিনি সাংস্কৃতিক বহুত্বে বিশ্বাস করতেন এবং বহুত্বের ব্যাপারটা আমাদের জানা ছিল না। সেটার বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রবন্ধ লিখেছেন, বাংলা ভাষায়ও প্রবন্ধ লিখেছেন। সাংস্কৃতিক বহুত্বের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সবাই মিলে মানবসমাজের বাঁচার যে আকাক্সক্ষা সেটা তিনি তুলে ধরেছেন এবং সেটাকে একটি আন্দোলনে রূপ দেওয়ার জন্য নানাভাবে কাজ করেছেন।

তিনি লেখক ও গবেষক ছিলেন। লেখা এবং গবেষণায় তিনি অসাধারণ পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি এই বাঙালি মুসলমানের পত্র-পত্রিকায় সাধনার বিষয়ে মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র বই লিখে গবেষণা কিভাবে করতে হয় এবং এই গবেষণার মাধ্যমে কিভাবে তত্ত্ব অনুসাধন করতে হয় ও তত্ত্বনিষ্ঠ হতে হয় সেটা তিনি আমাদের বিশদভাবে দেখিয়েছেন।

তাঁর অসাধারণ কাজগুলো হচ্ছে আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণমূলক রচনা। তিনি আমার একাত্তর বইটা লিখেছেন এবং এরপর তিনি আর দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ লিখেছেন। বইগুলোর ভাষা, সরল উপস্থাপনা, বিষয়জ্ঞান, তত্ত্বনিষ্ঠা অসাধারণ এবং সুপাঠ্য। সবমিলিয়ে বলা যায় আনিসুজ্জামান স্যার একজন বিশাল মাপের মানুষ। তাঁর স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। দেশে-বিদেশে নানা পুরস্কার পেয়েছেন। এসব পুরস্কারের ভেতর দিয়ে তিনি কখনো আত্মগড়িমা প্রকাশ করেন নাই। কখনো এসব পুরস্কারের কথা নিজে উল্লেখ করতেন না। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও সৌজন্যপরায়ন ছিলেন। তাঁর বাসায় আমরা যতবার গেছি তাঁর ও ভাবীর সৌজন্যে আমরা মুগ্ধ হয়েছি এবং তাঁর পুত্র কন্যারাও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এরা সরল, বিনয়ী ও সহজ মানুষ।

আনিস স্যার জীবনে আরো অনেক কাজ ও লেখালেখি করতে পারতেন। কিন্তু জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় নানা সমস্যার মধ্যে তিনি যেভাবে হাল ধরেছেন। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা শক্তির যখন উত্থান ঘটেছে তার বিরুদ্ধে তিনি নিজে যেমন মাঠে নেমেছেন সেটা সবাইকে বিস্মিত করে। সময়ের তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা এবং ভবিষ্যত নির্মাণের একজন অগ্রনায়ক তাকে আমরা বলতে পারি।

আমি প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর শোকে সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার নাই। কারণ এই প্রতিকূল পরিবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসায় তিনি উদ্বেলিত হতেন। কিন্তু সেখানে আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন। সবাই এককভাবে তাঁর কথা ভাবছি। সবাই সম্বলিতভাবে তাঁর জন্য ভাবার সুযোগ পাচ্ছি না। কারণ এক মহামারি কবলে পড়ে আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে স্যারের প্রতি পরম শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।


 

উনি একজন বিরল মানুষ

আবুল মোমেন

কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে আমার স্মৃতি এতে বেশি যে, তাকে হারানোর মুহূর্তে সবকিছু গুছিয়ে বলা সম্ভব নয়। ওনার সঙ্গে তো এমনিভাবে পারিবারিক যোগাযোগটা ছিল। কিন্তু ’৬৭ সালে তিনি যখন চট্টগ্রাম এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে তারপর থেকে আমরা বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে এবং আরও পরে গিয়ে আন্দোলনের কাজে একসঙ্গে যুক্ত ছিলাম। উনি প্রথম আমাদের সথে ফিল্ম সোসাইটিতে যুক্ত হন। সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। আমি ছিলাম সম্পাদক। সেই সুবাদে তাঁকে মাঝেমধ্যে শহরে আসতে হতো। ছোটখাটো মিটিংয়েও তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে আসতেন। তারপরে ফুলকি যখন করি ’৭৮ সন থেকে তিনি চট্টগ্রামে থাকা অবদি এর সভাপতি ছিলেন। এরপরে আমরা একটি ট্রাস্ট করেছিলাম বিদ্যাসাগর রোকেয়া শিক্ষা ট্রাস্ট। এটাতে তিনি মৃত্যুপর্যন্ত সভাপতি ছিলেন।

এর বাইরে ওনার সম্পর্কে বলব, উনি একজন বিরল মানুষ, সবসময় একটি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে তিনি তার অবস্থান থেকে কাজ করেছেন। তিনি খুব কৃতী ছাত্র, সফল অধ্যাপক এবং অত্যন্ত খ্যাতিমান গবেষক। প-িত মহলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। এটা সত্ত্বেও তিনি দেশের সংস্কৃতকর্মী, লেখক, সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং যারা তার ঘনিষ্ঠ পরিচিত তাদের পরিবার-পরিজন-সন্তান সবার খোঁজখবর রাখতেন। প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে দাম দিতেন। এরকম একজন মানুষ কিন্তু পাওয়া খুবই মুশকিল যিনি সর্বোচ্চ সম্মান, এমনকি ভারত রাষ্ট্রের সম্মাননা অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেও তিনি ব্যস্ত থেকেছেন। তিনি সংবিধানের বাংলাভাষ্য রচনা করেছেন। তিনি প্রথম শিক্ষা কমিশনে ছিলেন। এছাড়া বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আবার বন্ধুবৎসল, আড্ডাপ্রিয় মানুষ হিসেবে তাঁকে আমরা পেয়েছি। আর বাংলাদেশের যে অভিযাত্রা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ সেখানে কিন্তু তিনি তাঁর অবস্থানটি সঠিক ও সুদৃঢ় রেখেছেন। তাঁর একটি অবস্থান স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এজন্য বিরোধিতার তিক্ততা, বৈরিতা, ক্ষোভ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার ব্যক্তিত্বের প্রসন্নতা এবং ¯িœগ্ধতা বরাবর বজায় ছিল। তাঁর শূন্যতা অপূরণীয়, নির্দ্ধিধায় বলা যায়।

 


 

তিনি সমগ্র জাতির অভিভাবক ছিলেন

গোলাম মুস্তাফা

প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যু আমাদের জাতি ও দেশের জন্য আক্ষরিক অর্থে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কৃতী অধ্যাপক ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ে অধ্যাপনার বাইরেও তিনি সমগ্র জাতির অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পরিচ্ছন্ন চিন্তা, পরিণত বুদ্ধি এবং দেশ  মানুষের প্রতি তাঁর যে সহজত ভালোবাসা ছিল সেটি তাঁর সমস্ত কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি বাংলা সাহিত্যে গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন। সমাজের প্রেক্ষাপটে, সাহিত্যের বিবর্তনে এবং সাহিত্যে প্রতিফলিত জনমানুষের যে চিত্র আবিষ্কার করা যায় সেটি আনিসুজ্জামান স্যার বাংলা সাহিত্যে আমাদের দেখিয়েছেন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের যে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ আছে স্বরূপে সন্ধানে। সেখানে তিনি বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে আমাদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ও নানা ধরনের অপচেষ্টা বা অপরিকল্পনা অনেকসময় ছিল সেগুলো তিনি নিরসনের চেষ্টা করেছেন এবং তিনি বাঙালি জাতিসত্তার প্রকৃতরূপটি সেখানে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। আমরা মনেকরি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের। তিনি ইতিহাসের ও সমাজের নানা বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন এবং মানুষের যে মুক্তির সংগ্রাম তার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।

১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিসংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন। আমার মনে পড়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে আনিসুজ্জামান সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত মূল্যবান বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজকের যে আন্দোলন সে আন্দোলনে জনগণ আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে গেছে। জনগণের কাছে আমাদের আবেদন আমরা আপনাদের সঙ্গে চলতে চাই, দয়া করে আমাদের সঙ্গে নিন। এই যে জনগণের শক্তি এবং তাদের আন্দোলনে অগ্রগামিতা এটা আনিসুজ্জামান খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং বুদ্ধিজীবীর অহমিকা বাদ দিয়ে জনগণের সংগ্রামী যে গৌরব সেটিকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

আমরা জানি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে তিনি অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। সেটি হলো বাংলাদেশের সংবিধান বাংলাভাষায় রচনা করা। সেটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে পৃথিবীতে একটি মাত্র সংবিধান আছে যেটা বলা হচ্ছে বাংলা ভাষায় তার যে প্রাধান্য সেটি বজায় থাকবে। সংবিধানের ১৯২ অর্থাৎ সর্বশেষ ধারায় বলা আছে যে এই সংবিধানের একটি বাংলা পাঠ ও একটি ইংরেজী পাঠ থাকবে। বাংলা ও ইংরেজী মধ্যে কোনো বিরোধ উপস্থিত হলে বাংলা পাঠই প্রাধান্য পাবে। এটি সংবিধান রচনার ইতিহাসে একটি বড় ধরনের অর্জন বলে আমরা মনে করি। বিচারপতি মো. হাবিবুর রহমান লন্ডনের একটি আলোচনা সভায় বলেছিলেন এই যে বাংলায় সংবিধান প্রণয়ন হলো। এটি আমাদের বিচার বিভাগ ও সংবিধান চর্চার সংস্কৃতিতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অবদান এই সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ করা যাবে না। কিন্তু তাঁর অবদানকে যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখব তিনি বিদ্যাচর্চার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি মানুষের মুক্তির কথা, দেশের কল্যাণের কথা বলেছেন। এখানেই আনিসুজ্জামানের অনন্যতা।