‘শব্দ দূষণ’ রোধে সুজনের একক লড়াই

নিজস্ব প্রতিবেদক »

নগরীর রাস্তায় নামলে মাঝে মাঝে মনে হয় গাড়ি চালকেরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কোন কিছু সামনে পড়লেই কানফাটা শব্দে বেজে উঠছে হর্ন। এক সেকেন্ডও যেন অপেক্ষা করতে রাজি নন চালকেরা। শুধু গাড়ির হর্ন নয়- এই শহরে নির্মাণ কাজ, গ্রিল, টাইলস কাটা, মেশিনে ইট ভাঙা, মাইক বাজানো, জেনারেটরের শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা।

আর এই শব্দ দূষণ প্রতিরোধ কিংবা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতায় অভিনব কায়দায় একক অবস্থান কর্মসূচি পালনে মাঠে নেমেছে সুজন বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তি।

কালের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিবাদেরও ধরনও বদলে যায়। কেউ নিজের শরীরে আগুন দিয়ে, কিংবা নানান কায়দায় প্রতিবাদ জানায়। তবে শব্দ দূষণ নিয়ে অভিনব এমন প্রতিবাদের দৃশ্য দেখা গেছে নগরীর চেরাগী মোড়ে।

‘শান্তিতে বাঁচতে চাই, শব্দ দূষণমুক্ত বাংলাদেশ চাই’ স্লোগানকে সামনে রেখে ‘সেভ গার্লস ওয়ার্ল্ডওয়াইজ’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সুজন বড়ুয়া শব্দ দূষণ নিয়ে বিভিন্ন স্লোগানের ফেস্টুন হাতে নিয়ে এই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

স্লোগানগুলোর মধ্যে ছিল- ‘হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ করুন’, ‘উচ্চ শব্দ সবার জন্য ক্ষতিকর’, ‘শব্দ দূষণ বন্ধ করুন’, ‘সহনীয় শব্দ ব্যবহার করুন’।

গতকাল শুক্রবার বিকালে নগরীর চেরাগী মোড়ে কথা হয় সুজন বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষ হিসেবে এটি আমার মানবিক দায়িত্ব, রেসপন্সিবিলিটি আছে। শব্দ দূষণমুক্ত একটা অবস্থান তৈরি করতে চাই- সবার সহযোগিতায়। অন্যান্য রাষ্ট্রে দেখা যায়, রাস্তার পাশে কিংবা ফুটপাতে কিছু চেয়ার থাকে, ওগুলোতে বিভিন্ন বয়সের মানুষ বসে বই পড়ে, আড্ডা দেয়, সময় কাটায় মানসিক প্রশান্তির জন্য। যদি শব্দ দূষণ থাকে তাহলে তা আমাদের দেশে সম্ভব নয়। এই সমস্যা বন্ধ হলে আমাদের দেশেও বিদেশের মতো বই পড়ার বিষয়টি আয়ত্তে আসবে। শব্দ দূষণ বন্ধ করতে পারলে পরে বায়ু দূষণ নিয়েও কাজ করবো।’

তিনি বলেন, ‘আজ আমি রাস্তায় বসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি- এটি আমাদের ২৬তম কর্মসূচি। এই কর্মসূচি শুরু করেছি ২১ জুলাই থেকে। এই দুই মাসের প্রত্যেকদিন আমার পক্ষে কর্মসূচি পালন সম্ভব ছিলোনা। তবে আমার একটি আশা আছে, আর ঐ আশার আলো মনে ধারণ করে সামনের দিকে এগোচ্ছি।’

সুজন বড়ুয়া বলেন, ‘শুধু এখানেই এই কর্মসূচি পালন নয়, চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টেই এ কর্মসূচি পালন করেছি। যেমন- আগ্রাবাদ, জিইসি মোড়, প্রবর্তক মোড়, জামাল খান, বহাদ্দারহাটসহ বিভিন্ন জায়গায় এই কর্মসূচি পালন করে আসছি। তবে বসে অবস্থান কর্মসূচি করছি আজ (গতকাল) দ্বিতীয় বারের মতো। আরেকদিন বসেছিলাম এই চেরাগী মোড়ে, প্রায়ই আড়াই ঘণ্টা। আমরা সাধারণত সংগঠনের পক্ষ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কর্মসূচি পালন করে থাকি।’

শব্দ দূষণটি মূলত ড্রাইভার পক্ষ থেকেই হচ্ছে, তারা যেন আমাকে দেখে, সচেতন হন। আমি বিশ্বাস করি এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।’- বলেন অবস্থান কর্মসূচি পালনকারী সুজন বড়ুয়া।

এছাড়া সুজন বড়ুয়ার কিছু প্রস্তাবনাও রয়েছে। তা হলো- ক. নির্দিষ্ট পথ বা জেব্রা ক্রসিং ছাড়া পিপীলিকার মত রাস্তা পারাপার নিষিদ্ধ করা হোক – এতে চরম মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। খ. নির্দিষ্ট পথ বা জেব্রা ক্রসিং ছাড়া রাস্তা পারাপার করলে কান ধরে উঠাবসা করানো ও নগদ ১৫০০ টাকা ফাইন করা, অনাদায়ে আরও ৫০ বার কান ধরে উঠাবসা করানো হোক। মানুষের কল্যাণে মানুষকে নিয়ম পালনে বাধ্য করা হোক। গ. পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। ঘ. সকল হাইড্রোলিক হর্ন অচিরেই রিমুভ করা হোক। ঙ. হাইড্রোলিক হর্ন রিমুভ করার পর সেই গাড়ির নাম্বার অনলাইনে আপডেট থাকতে হবে, পরবর্তীতে যদি আবার সেই গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন পাওয়া যায় তাহলে সেই গাড়ির লাইসেন্স চিরতরে বাতিল করা হবে। চ. উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী সকল যানবাহন রাস্তায় নিষিদ্ধ করতে হবে। ছ. আইনের লোক নিজেই যেন আইন লঙ্ঘন করে শব্দ দূষণ না করে, আইনের লোক আইন ভঙ্গ করলে সাধারণ মানুষ কোনদিন আইনকে মানবে না এবং সম্মান করবে না – কথাটা মনে রাখা এবং পালন করা আবশ্যক। জ. আইন বা অন্য কোন বাহানায় শব্দ দূষণ করা যাবে না, কারো শ্রবণশক্তি নষ্ট করার অধিকার কারোর নেই। ঝ. অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুমতি সাপেক্ষে শব্দ যেন ৬০ ডেসিবলের উপরে না উঠে তা নিশ্চিত করা হোক এবং তা যেন ৫ মিনিটের উপর অতিক্রম না করে। ঞ. মোটকথা অ্যাম্বুলেন্স , গ্যাস ও ফায়ার সার্ভিস এর গাড়ি ছাড়া অন্য কোন শব্দ দূষণ হতে পারবে না। ট. ট্রেনের হর্ন পরিবর্তন করতে হবে, এটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। ঠ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে সাইন টাঙ্গিয়ে কড়াকড়ি শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ড. আবাসিক এলাকায় কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে যেন কোন সাউন্ড সিস্টেমের অনুমতি দেওয়া না হয়, ঢ . অনুষ্ঠান করে শব্দ করতে চাইলে তারা নির্জন এলাকায় গিয়ে অনুষ্ঠান করুক যেখানে জনসাধারণের উচ্চ শব্দ জনিত কারণে যেন কোন সমস্যা না হয়।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শব্দ দূষণের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান প্রথম। দ্বিতীয় স্থানে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। তালিকার শীর্ষ ৫ শহরের মধ্যে রাজশাহী চতুর্থ এবং ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি পঞ্চম। অর্থাৎ শব্দ দূষণে শীর্ষ ৫ শহরের মধ্যে ৪টিই দক্ষিণ এশিয়ার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডিবি (ডেসিবেল) এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডিবি। সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডিবি এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডিবি পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গাড়ির শব্দ, উড়োজাহাজ চলাচল, রেল চলাচল, যন্ত্রপাতি, শিল্প এবং বিভিন্ন উৎসব ও বিনোদনমূলক আয়োজনের শব্দ দূষণ মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’