লুইস গ্লিক : এক অভ্রান্ত মানবিক চেতনার কবি

মুজিব রাহমান

অনুবাদ ও ভূমিকা

২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী মার্কিন কবি লুইস গ্লিক যাঁর অভ্রান্ত মানবিক চেতনা ও কবিতার নিরাভরণ ভাষিক সৌন্দর্যবোধ সাহিত্যে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও সংবেদকে বৈশ্বিক মাত্রা দিয়েছে।

 

কবি সম্পর্কে :

অ্যামেরিকার নিউ ইয়র্ক নগরে ১৯৪৩ সালে তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠেছেন লং আইল্যান্ডে। পড়াশুনো করেছেন সারাহ লরেন্স কলেজ এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সমসাময়িক প্রতিভা-প্রদীপ্ত অ্যামেরিকান কবিদের মাঝে তিনি বিশিষ্ট এবং আপন স্বাতন্ত্র্যে প্রোজ্জ্বল। কাব্যিক শিল্প কুশলতার সূক্ষ্মতায়, সংবেদিতায়, অকপট সারল্যে তিনি প্রাজ্ঞ এক কবিসত্তা। অস্তিত্বের একাকীত্বের প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি, পারিবারিক সম্পর্ক, বিচ্ছেদ, এবং মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় তাঁর কবিতার প্রাণ। সমসাময়িক অ্যামেরিকার বিখ্যাত কবি রবার্ট হেস তাঁর সম্পর্কে বলেছেন –

‘সমসাময়িক  শুদ্ধতম গীতি কবিদের মাঝে তিনি একজন। শতভাগ সম্পন্ন কবিদের তিনি একজন।’

“তাঁর অভ্রান্ত কাব্যিক কণ্ঠস্বর এবং প্রকাশের নিরাভরণ সৌন্দর্য প্রাতিস্বিক অস্তিত্বকে বৈশ্বিক করে তোলে।” তাঁর সম্পর্কে এ অনন্য পর্যবেক্ষণ নোবেল কমিটির।

গ্লিক বর্তমানে  ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক লেখক।

ম্যাসাসুসেটস -এর ক্যামব্রিজে বসবাস করেন।

সত্তর এবং আশির দশকের অ্যামেরিকান কবিদের  বিশেষ করে ১৯৭৫ পরবর্তী অ্যামেরিকান কবিদের তালিকায় যেকজন বিখ্যাত কবি রয়েছেন তাদের মধ্যে লুইস গ্লিক (১৯৪৩) অন্যতম।

The Norton Anthology of American Literature-এর দ্বিতীয় সংস্করণের দ্বিতীয় ভলিউমের সূচিপত্রে একেবারে শেষের সংযোজনটির শিরোনাম :

After 1975 : Some poems from a younger generation- এ শিরোনামাধীন কবিদের মাঝে চতুর্থ জন বিখ্যাত কবি Robert Pinsky এবং পঞ্চম জন  এবারের নোবেল লরিয়েট লুইস গ্লিক।

এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তাঁর The Garden কাব্যগ্রন্থের পাঁচটি কবিতা।

৭৭ বছর বয়স্ক লুইস গ্লিক বিগত ২৭ বছরে প্রথম অ্যামেরিকান নারী কবি যিনি ১৯৯৩ সনে টনি মরিসনের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভের পর এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনকারী ১১৭তম লেখক।

বারোটি কাব্য সংকলনে ধরা আছে তাঁর অসামান্য সব কাব্যকৃতি। ১৯৬৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্য Firstborn  বা ‘প্রথম সন্তান’ প্রকাশিত হবার পরেই তিনি সমসাময়িক আমেরিকান সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

তাঁর কবিতার শাব্দিক সারল্য অসতর্ক পাঠককে সহজেই প্রতারিত করতে পারে। অত্যন্ত সহজভাবে গভীর কথাটি উচ্চারণে তাঁর পারঙ্গমতা প্রবাদপ্রতিম। তাঁর কাছে :

Nothing is final.

Certainty is an illusion

কোন কিছুই যে চূড়ান্ত নয়, কোন কথাই যে শেষ কথা নয় এবং নিশ্চয়তা যে এক কুহকের নাম তা কবি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন।

তাঁর উচ্চারণ :

“all human beings are divided/ into those who wish to move forward/ and those who wish to go back”

বিশ্বাসের তত্ত্বগুলো গ্রহণের বিষয়ে গ্লিকের ঋজুতা, অনৈৎসুক্য ও অসম্মতিজ্ঞাপক মনোভঙ্গির জন্যে তাকে তুলনা করা হয় অসামান্য নারী কবি এমিলি ডিকিনসনের সঙ্গে।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অধ্যাপক  গ্লিকের কবিতা প্রথম দৃষ্টিতে কাব্যিক শব্দালংকার বিবর্জিত, অনভিজাত। কিন্তু তাঁর কবিতার নিবিষ্ট পাঠ পাঠককে বুঝিয়ে দেয় একটি নিরাভরণ কবিতাও কতোটা দুরূহ  জীবন্ত হতে পারে।

১৯৯৩ সালে তাঁর পাঠক-সমালোচক নন্দিত কাব্যগ্রন্থ The Wild Iris (1992) কাব্যগ্রন্থের জন্যে তিনি অর্জন করেছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার। ২০১৪ সালে তিনি অর্জন করেন ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড।

Averno শ্রেষ্ঠ কাব্যকৃতির একটি।  Averno শব্দটি নেপলসের পশ্চিমে অবস্থিত জ্বালামুখ বা গহ্বরটিকে বোঝায় যেটিকে প্রাচীন রোমানরা পুরাণের প্রেতলোক বা যমপুরীতে প্রবেশ-গহ্বর হিসেবে বিবেচনা করতেন।

তাঁর কবিতার কেন্দ্রে  একদিকে যেমন শৈশব, পারিবারিক জীবন, বাবা-মা, ভাই-বোন এবং নিকটজনদের সাম্পর্কিক নিবিড়তা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে অন্যদিকে তেমনি  গ্রিক এবং রোমান পুরাণও তাঁর কবিতায় এক প্রাতিস্বিক ভিন্ন মাত্রায় পুনরুত্থিত হয়েছে।

স্পষ্ট করে পাঠককে সরাসরি বলার সূক্ষ্ম শিল্পকৌশলটি তাঁর কবিতার কুললক্ষণ।

২০১৫ সালে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছ থেকে ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ  মেডেল লাভ করেছিলেন গ্লিক। সেসময় কবি বলেছিলেন, তাঁর গভীর অনুসন্ধানী কবিতায় নিসর্গের নীরব নাটক এবং আমজনতার অব্যক্ত আবেগ ধরা আছে। ২০০৩ সালে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন অ্যামেরিকার পোয়েট লরিয়েট।

কবির দৃষ্টিতে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি “Faithful and Virtuous Night” (2014)  কাব্যগ্রন্থটি। তাঁর কবিতার আস্বাদ গ্রহণ করতে আগ্রহ সম্পন্ন পাঠককে

‘বিশ্বস্ত এবং পুণ্যময় রজনী’ শীর্ষক কাব্যটি  হাতে নিতে বলেছেন এই নোবেল বিজয়ী জগতনন্দিত কবি, গ্লিক।

জীবন, পুনরুজ্জীবন, উপকথা আর মিথের ধ্রুপদী প্রয়োগ তাঁর কবিতাকে কালজয়ী কবিতার ধারায় প্রবহমান রেখেছে। তাঁর Oneiricপ বা স্বপ্নবিষয়ক কবিতা, হারানোর গভীর বোধে উন্মথিত কবিতা, ডিডো, পার্সেফোনে এবং ইউরিডিসের মিথ-নিষিক্ত বেদনাসিক্ত কবিতাবলি বিশ্বকবিতায় নূতনভাবে উপস্থাপিত।

জগৎ-জীবনের প্রতি শৈশবে যে দৃষ্টিতে আমরা তাকাই তার মাহাত্ম্য কবির বিবেচনায় অনতিক্রম্য।

তাঁর কবিতায় তিনি লিখেছেন:

We look at the world once, in childhood.

The rest is memory.

তাৎক্ষণিক মন্তব্যে নির্জনতা পিয়াসী এই কবি নোবেলের মতো বড়ো পুরস্কার প্রাপ্তিকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বড়ো এক বিঘœসৃষ্টিকারী বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারণ, তখনো তাঁর ভাষায়, কিঁচকিঁচ করে টেলিফোন বেজেই যাচ্ছিল।