৩২২ কোটি টাকার ১০ ইঞ্জিন ৭ মাস গাছতলায়

ইঞ্জিন নিয়ে কমিটি কমিটি খেলা চলছে- প্রকল্প পরিচালক
কারিগরি কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে- রেল মহাপরিচাল

ভূঁইয়া নজরুল <<<<
সাত মাস ধরে গাছতলায় অলস পড়ে আছে ৩২২ কোটি টাকার ১০ রেলইঞ্জিন। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কোরিয়া থেকে মিটার গেজে (পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়েতে) চলাচলের জন্য এসব ইঞ্জিন আনা হলেও এখনো তা চালু করা যাচ্ছে না। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিন আনা হয়নি বলে কমিটির পর কমিটি হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
গত রোববার চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে ডিজেলশপে গিয়ে দেখা যায়, ৩০০১ থেকে ৩০১০ সিরিয়াল পর্যন্ত ১০টি রেলইঞ্জিন বিভিন্ন গাছের তলায় ডাম্পিং অবস্থায় রয়েছে। কোরিয়া থেকে এসব ইঞ্জিন গত ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে খালাস করে এখানে এনে রাখা হয় বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে পাহাড়তলী ডিজেল শপের কর্মব্যবস্থাপক রাজীব কুমার দেবনাথের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করলেও তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। সাধারণত বিদেশ থেকে ইঞ্জিন আনার এক মাসের মধ্যে তা রেললাইনে চালানো হয়। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়েতে ইঞ্জিন সঙ্কট থাকার পরও তা কেন চালু করা হচ্ছে না?
জানা যায়, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য লোকোমেটিভ (ইঞ্জিন), রিলিফ ক্রেন এবং লোকোমেটিভ সিমুলেটন সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় এই ১০টি ইঞ্জিন ৩২২ কোটি টাকায় কোরিয়া থেকে কেনা হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে কেনা এই প্রকল্পের পরিচালক নুর আহাম্মদ হোসেন। ইঞ্জিনগুলোর সমস্যা কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ ইঞ্জিনে তৈরিতে যে শর্ত দেয়া হয়েছিল এখানে সেই শর্ত মানা হয়নি। এছাড়া ইঞ্জিন সংগ্রহের পূর্বে প্রি শিপমেন্ট পরিদর্শন করার থাকলেও এসব ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এসব বিষয় আমি সচিব মহোদয়কে ইনফর্ম করেছি।’
কিন্তু এসব সমস্যা নিয়ে তো রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা। ইতিমধ্যে এই কমিটি রিপোর্টও দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা রেলসচিবের কাছে ইতিমধ্যে রিপোর্ট জমাও দিয়েছি। এখন বাকি পদক্ষেপ তিনি নেবেন।’
এদিকে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে চুক্তি অনুযায়ী যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করা হয়নি তা উঠে এসেছে। চুক্তির বাইরে ইঞ্জিনগুলো কেন গ্রহণ করা হলো এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত তাদের শনাক্তে কাজ চলছে বলে জানা যায়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরও এখন আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক নূর আহমদ হোসেন বলেন, ‘রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখন কমিটি কমিটি নাটক খেলছে।’ চার সদস্যের নতুন কমিটি তৈরি করেছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আরেকটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছি। এ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ইঞ্জিনগুলোর পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
এসব ইঞ্জিনের সমস্যা কী?
প্রকল্প পরিচালক এবং রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রেলকে গতিশীল করতে ১২০ থেকে ১৩০ কি. মি. গতিতে ট্রেন চালাতে ৭ মাস আগে ৩২২ কোটি টাকায় কেনা হয় ১০টি ইঞ্জিন। ইঞ্জিনগুলোতে টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হয়েছে, যা পুরনো মডেলের। ফলে ইঞ্জিনের গতি (হর্সপাওয়ার) ও ব্যাকআপ সিস্টেম কম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। এছাড়া চুক্তিপত্র বহির্ভূত ৩টি ক্যাপিট্যাল কমপোনেন্টসে ভিন্নতা আছে। সরবরাহ করা ইঞ্জিনগুলোতে ক্যাপিট্যাল-অলটারনেটর, ট্রাকশন মোটর সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির এসব ইঞ্জিন এগুলো ছাড়া দেশে এলো কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক নুর আহমদ হোসেন বলেন,‘ ইঞ্জিন তৈরির সময় রেলওয়ের একটি টিম সেখানে ট্রেনিং নেয়ার কথা ছিল। রেলওয়ের একটি কারিগরি টিম পরিদর্শন করার করার কথা ছিল এবং সর্বশেষ মাল ডেলিভারির আগে প্রিশিপমেন্ট পরিদর্শন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এসবের কোনোটি করা হয়নি।’
কিন্তু এগুলো ছাড়া আপনি মাল গ্রহণ করলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রেলওয়ের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে কারিগরি টিম নিয়ে পরিদর্শন, ট্রেনিং করার অনুমোদন দেয়নি। সর্বশেষ প্রি শিপমেন্ট পরিদর্শনও করা হয়নি।’
তবে রেলওয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী জানান, ইঞ্জিন ক্রয় এবং তা গ্রহণে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রকল্প পরিচালক। তাই এ বিষয়ে অপারগতা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।
রেলওয়ের ইঞ্জিন ক্রয়ে এই অনিয়ম এবং ইঞ্জিনগুলো সাত মাস ধরে পড়ে থাকার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি এবং টিআইবি ইন্টারন্যাশনাল এর সাবেক পর্ষদ সদস্য প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন,‘ বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় রেলওয়েকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং ইঞ্জিনের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার সুযোগে একটি চক্র অনিয়মের মাধ্যমে চুক্তি বর্হিভূত ইঞ্জিন নিয়ে আসছে। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষতি হলেও যাতে দুর্নীতিবাজরা প্রশ্রয় না পায়।’
এসব ইঞ্জিন কি ব্যবহার করা যাবে?
যে মডেলের যন্ত্রপাতি দিয়ে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করা হয়েছে সেগুলো দিয়ে কি ইঞ্জিনগুলো চালানো যাবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক নূর আহমদ হোসেন বলেন,‘ ইঞ্জিন চালানো যাবে। কিন্তু চুক্তিতে যা থাকার কথা ছিল তা দেয়া হয়নি।’ রেলওয়ের অপর একাধিক উর্ধতন প্রকৌশলী জানান, ইঞ্জিনগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে কেনা হয়েছিল সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না। তবে ইঞ্জিনগুলো পরিচালনা করা যাবে। এর গতি তুলনামূলকভাবে কম থাকবে। রেলওয়ে এখন উচ্চ গতির ট্রেন পরিচালনার দিকে নজর দিচ্ছে। সেই আলোকেই এসব ইঞ্জিন আনা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়েত ইঞ্জিন সংকট প্রকট। এতে ট্রেন পরিচালনায় হিমশিত খেতে হচ্ছে। নতুন এসব ইঞ্জিন যুক্ত করা গেলে রেল পরিচালনায় আরো গতি আসতো।